বাশঁ ছাড়া কি গহীন গ্রামের চিত্রকল্প ফুটিয়ে তোলা যায়? বাশঁ আবহমান জাতির জীবনযুদ্ধের সংগ্রামী জীবনধারার চিরায়ত বন্ধু। বাংলার সবুজ শ্যামল নিসর্গকে একাই কুক্ষিগত করে রাজার আভিজাত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাঁশবন।
জীবন বাঁচাতে কখনো বা দেশ বাঁচাতে হাজার বছর ধরে জাতি লড়েছে প্রতিরোধে, সংগ্রামে, বাশেঁর লাঠি দিয়ে, মাথা বাঁচিয়েছে বাঁশের ঢাল দিয়ে, বাঁশের তীর ধনুক, বর্শী ছুড়ে শত্রুকে ঘায়েল করেছে, বাঁশের কেল্লা বানিয়ে আত্মরক্ষা করেছে। স্থাপত্যের ঘর বাড়ি, ছাউনি, বেড়া, ইত্যাদি বানিয়েছে, নিত্য ব্যবহার্য কাজে শিশুর দোলনা থেকে শুরু করে জুড়ি, লাই, বেত, তুরুম, বাঁশি ইত্যাদি। এ উপকরণগুলোও ছিল জাতির কাছে সহজলভ্য। যোগাযোগ কাজে সাঁকো, সেতু, জাতির কৌম কৃষি ও সমাজব্যবস্থায় মাটি বাঁশ বেত কাঠ প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ সভ্যতারও মূল ভিত্তি।
এমনকি একসময় জমিদারি আমলে “বাঁশ মহালের” জন্যে আলাদা খাজনা নির্ধারিত ছিল। জমিদারের দেহলিজে, উৎসব, পালা, পার্বণে বসার উপকরণ যেটি ছিল তাও ছিল বাঁশের তৈরি চাটাই। বাঁশ বেত কাঠ যেহেতু পচনশীল উদ্ভিদ সেহেতু এসব উপকরণভিত্তিক কারুশিল্প কেমন ছিল আজ তা জানার কোনো উপায় নেই।
এদেশের পাহাড়ে লোকেরাও ছন বাঁশের নির্মিত ঘরবাড়িতে বসবাস করে, হিংস্র জীবজন্তুর আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য । বাঁশের মাচাং ঘর, বাঁশের বেড়া বাঁশের জানালা, বাঁশের যে ঘর তৈরি করত, সে ঘর ছিল পাহাড়ের চিরায়ত জলবায়ু আবহাওয়া পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো পরিবেশবান্ধব “পাহাড়ী ঘর”। ঘর গেরস্থালি কাজের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বাঁশ জাতির অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জোরালো ভূমিকা রেখেছিল।
বেশিরভাগ মানুষ এক সময় “ বাঁশ কাঠ” ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। এই পেশার সাথে গাঁয়ের এক শ্রেণির পেশাজীবী মানুষেরও উদ্ভব হয়েছিল, যাদের কাজ ছিল বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে সাইজ করে বাণ্ডিল করা এবং তা পানিতে ভাসিয়ে হাটবাজারে, গঞ্জে বিক্রির জন্যে নিয়ে যাওয়া, মাস শেষে শ্রমিকদের জন্যে নির্দিষ্ট বেতনও বরাদ্দ ছিল। এক সময় নদীতে সাম্পান মতো ভাসমান “বাঁশের চালি” নদীর দৃষ্টিন্দন রূপকে বাড়িয়ে দিত। এমনতায় বাঁশ ধ্বংসের কারণে এখন সেসব দৃশ্য সহসা চোখে পড়ে না।
পাহাড়ের একজন এমন বয়স্ক কারুশিল্পর কাছে জানা যায়, বর্তমানে বাঁশ ধ্বংসের কারণে এসব বাঁশের তৈরি কারুকাজ কিংবা নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য সামগ্রী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তিনি একজন সাবেক ইউপি সদস্য, তার বয়স শেষ প্রান্তে হলেও তিনি নিজের এমন একটা অভিজ্ঞতাকে এখনো হাতে ধরে রেখেছেন।
কথা হয় রাইখালি এবং ওয়াগ্গা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেশ কয়েকজন কারু শিল্পির সাথে, তারা জানান, এখন আগের মতো পাহাড়ে বাঁশ উৎপাদন হয়না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষ বন জংগল বাঁশ ঝাড় কেটে ঘরবাড়ী তৈরী করছে, তাছাড়া এখন প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে সাথে মানুষ স্টিলের তৈরী বিভিন্ন গৃহস্থালি জিনিষপত্র ব্যবহার করছে। হয়তোও এমন একদিন আসবে পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁশ নামক এই বস্তুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য পূর্বের ইতিহাসে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.