পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই যুগের অধিক সময় ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘাত নিরসন, স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই হয়। চুক্তি সইয়ের দীর্ঘ ২৭ বছর বছরেও চুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে পাহাড়ের মানুষের মধ্যে হাতাশা, অসন্তোষ, ক্ষোভ, আস্থা ও অবিশ্বাস বাড়ছে। এমন অবস্থায় সোমবার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭ বছর পূর্তি উদযাপিত হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশী সময় ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাত অবসানের লক্ষ্যে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সই হয়। চুক্তি মোতাবেক ১৯৯৮ সালে জনসংহতি সমিতির তৎকালীন শান্তি বাহিনীর প্রায় দুই হাজার সদস্য সরকারের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয় ,পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ,পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন এর মতো প্রতিষ্ঠান গঠন করা হলেও সেগুলোর কার্যকর হতে পারেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কার্যত নিস্ত্রিুয়তা রয়েছে। এ চুক্তি স্বাক্ষরের ২৭ বছর পরও এখনো পাহাড় অশান্ত রয়েছে। কাংখিত সেই শান্তি ফেরেনি।
গেল ২৭ বছরে একাধিক পাহাড়ে একাধিক আঞ্চলিক দলের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) নামের দুটি দল ছাড়াও রয়েছে সুধাসিন্ধু খীসা ও রুপায়ন দেওয়ানের নেতৃত্বে এমএন লারমা গ্রুপের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ। তাছাড়া বান্দরবানে মগ পার্টি ও কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে আরো দুটি দলের আত্নপ্রকাশ ঘটেছে। এসব দলগুলো পরষ্পরের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে লিপ্ত।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭ বছর উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রকাশিত বুকলেটে বলা হয়, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাঁচটি রাজনৈতিক সরকার এবং দুইটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে কোন সরকারই রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসেনি। গত জুলাই-আগস্টে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর ৮ আগস্ট ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আজ প্রায় চার মাস অতিক্রান্ত হলেও সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের এখনো কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির স্বাক্ষরের পর ২৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে।
চুক্তির অধিকাংশ ধারার মধ্যে অবাস্তবায়িত বিষয়গুলোর মধ্য রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্য আইনী ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ,পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার অধীনে প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি ন্যস্ত করা,নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়ন ও স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণপূর্বক এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা,পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পার্বত্য পুলিশ বাহিনী গঠন,ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে জুম্মদের বেহাত হওয়া জায়গা-জমি ফেরত দেয়া এবং এলক্ষ্যে ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন,অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত সকল ইজারা বাতিল, ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার, ভারত-প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের জমিজমা প্রত্যার্পণপূর্বক তাদেরকে যথাযথ পুনর্বাসনসহ ইত্যাদি।
বুকলেটে অভিযোগ করে আরো বলা হয়, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান তো অর্জিত হয়ইনি, বরঞ্চ রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক আদিবাসী জুম্ম জনগণের উপর বৈষম্য ও বঞ্চনার স্টিমরোলার অধিকতর জোরদার হয়েছে, নৃশংস দমন-পীড়ন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম জোরদার হয়েছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনজীবনে অবৈধ গ্রেফতার, জেল-জুলুম, বিচার-বহির্ভুত হত্যা, অপহরণ, ভূমি বেদখল, স্বভূমি ও গ্রাম থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ, মিথ্যা মামলায় জড়িতকরণ, সাম্প্রদায়িক হামলা, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, নারীর উপর সহিংসতা ইত্যাদি নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত প্রতিটি সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও মানবাধিকার পরিস্থিতির কথা বললেই নানা কায়দায় উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যর্থতাকে এবং জুম্ম জনগণের উপর দমন-পীড়নকে ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করে আসছে বলে অভিযোগ।
বুলেটে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন তথা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের উপর চলমান বৈষম্য, দমন, পীড়ন ও বঞ্চনা গভীরভাবে উপলব্ধি করবেন এবং রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে এই বৈষম্য ও বঞ্চনা অবসানে দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে আসবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ, দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সচেষ্ট ও সক্রিয় হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।
রাঙামাটি জেলা আদালতের বিশিষ্ট আইনজীবি ও নারী নেত্রী সুস্মিতা চাকমা বলেন, পার্বত্য চুক্তির ২৭ বছরেও যে চাওয়া পাওয়া তা পার্বত্যবাসীর পূরণ হয়নি। তবে চুক্তি নিয়ে একদল বলছে চুক্তি বাস্তায়ন হয়নি আবার সরকার বলছে চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা জনগন তা বলবে।
বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে পার্বত্যবাসীর অনেক প্রত্যাশা ছিল উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এ সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে। কিন্তু এখনো পর্ষন্ত সরকার এ বিষয়ে আমলে নেয়নি এবং ইতিবাচক বক্তব্যে দিতেও দেখা যায়নি।
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে যে উদ্যোগ নেওয়ার কথা সেই উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না উল্লেখ করে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্যাঞ্চল শাখার সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদদের নির্বাচনের লক্ষে চুক্তির আলোকে স্থাণীয় বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রনয়ন করার কথা। কিন্তু এখনো পর্ষন্ত ভোটার তালিকা প্রনয়নের লক্ষ্য কোন প্রাথমিক লক্ষনও দেখতে পাওয়া যায়নি। এখানে ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য ভূমি কমিশন গঠন করা হলেও এ কমিশনের কার্যক্রমের কোন উদ্যোগ বা অগ্রগতি নেই। তাছাড়া আইন-শৃংখলা বিষয়ে স্থানীয় পুলিশ বাহিনী গঠন করার কথা থাকলেও তার কোন উদ্যোগ নজরে পড়েনি।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চুক্তিটা যে বাস্তবায়িত হবে না একথা কেউ বলছে না, আবার চুক্তি যে বাস্তবায়ন হবে তার কার্যকলাপও আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তাই পাহাড়বাসী এখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। তবে আমরা আশার আলো নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। আশার আলো ছেড়ে দেয়নি, এ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালীন সকারের কাছে চুক্তি বাস্তবায়নে কিছুনা কিছু উদ্যোগ গ্রহন করবে তার আশাও প্রকাশ করেন তিনি।
রাঙামাটিতে গণ সমাবেশঃ
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী সকল কার্যক্রম প্রতিরোধ করুন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলন জোরদার করুন-এ শ্লোগানে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ২৭ বছর উপলক্ষে সোমবার রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জেলা শাখার উদ্যোগে কুমার সুমিত রায় জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গনে গণ সমাবেশ ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা)। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের পরিষদ প্রাঙ্গনে আলোচনা সভা অনুষ্টিত হবে। এছাড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলায় জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে গণ সমাবেশের আয়োজন করেছে।
--হিলবিডি৪/সম্পাদনা/সিআর.