সোনালী ব্যাংক লংগদু শাখায় সরকারী অনুদান দেওয়ার নামে প্রায় ভাইসন্ন্যাদাম ও বগাচতর ইউনিয়নের তিন শতের অধিক গরীব ও অসহায় মানুষের স্বাক্ষর জাল করে ভূয়া ঋণ উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে। এতে গেল ১২ বছরে সুদে আসলে বর্তমানে এ ঋণের পরিমাণ দাড়িয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। তবে ভুক্তভোগীদের দাবী শুধু ভাইসন্ন্যাদাম ও বগাচতর ইউনিয়ন নয় পুরো লংগদু উপজেলায় প্রায় সাড়ে আটশত গরীব ও অসহায় লোকজনদের কাছ থেকে একটি দালাল চক্র সরকারী সহায়তার কথা বলে জাতীয় পরিচয় পত্রের(এনআইডি) ফটোকপি সংগ্রহ করে স্বাক্ষর জালিয়াতী করে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। ভূঁয়া ঋণ বাতিলের দাবীতে গেল রোববার লংগদু উপজেলা সদরে বিক্ষোভ-মানববন্ধনও করেছেন ভুক্তভোগীরা। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ম্যানেজার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কোন কথা বলতে চাননি।
এদিকে, গেল বছর ২৬ নভেম্বর ভুক্তভোগীরা জেলা পুলিশ কাছে আবেদন করেছেন। এতে পুলিশ সুপার লংগদু থানাকে তদন্ত করতে বলেন। এতে তদন্তে দায়িত্ব ডান উপ-পরিদর্শক মোঃ জয়নাল আবেদীন। তদন্তে তিনি ব্যাংকে গিয়ে ম্যানেজার তাকে জানিয়েছেন ২০১২ থেকে ২০১ সালে সোনালী ব্যাংক লংগদু শাখার ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন বিল্লু কুমার তংচংগ্যা। তার সময়ে এ ঋণ দেওয়া হয়েছে। এরকম ঋণ ৫০৬জন ভাইন্ন্যা আদাম ও বগাচতর ইউনিয়ন থেকে নিয়েছেন। তাদের প্রতিজনকে ২৫ থেকে ৩৫ হাজার ঋণ দেওয়া হয়েছে। তবে কত টাকা ঋন দেওয়া হয়েছে তার হিসাব দেননি ম্যানেজার। এ ঋন নেওয়ার ব্যাপারে ৩ জন ও গ্রামে ২ জন দালাল জড়িত রয়েছেন। অপর একটি হিসেবে দেখা গেছে এসব লোকজনদের নামে প্রায় দেড় কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। ২০১২-১৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্ষন্ত সুদে আসলের ঋণের পরিমাণ দাড়িয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগে জানা গেছে, রাঙামাটির লংগদু উপজেলা সদরে রাষ্ট্রয়ত্ব দুটি ব্যাংক রয়েছে একটি হল সোনালী ব্যাংক ও অপরটি হল কৃষি ব্যাংক। এসব ব্যাংক দৈনিক লেনদেন ছাড়াও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ঋন(এমএমই), পল্লী গৃহায়ন ঋন, ক্ষুদ্র খামার, ক্ষুদ্র ব্যবসা ঋণ, কৃষি ঋণ বানিজ্যিকসহ বিভিন্ন ঋন দিয়ে থাকে। ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের দিকে ৫নং ভাসান্যাদাম ও ৪নং বগাচতর ইউনিয়নের অসহায় ও গরীব লোকজনদের গিয়ে সোনালী ব্যাংক লংগদু শাখার কয়েকজন অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তার যোগাসাজেশে স্থানীয় একটি দালাল চক্র সরকারী সহায়তার কথা বলে জাতীয় পরিচয় পত্রের(এনআইডি) ফটোকপি সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ৫নং ভাসান্যাদাম ইউনিয়নে ২১৮ জন ও ৪নং বগাচতর ইউনিয়নে ৮৬ জনের ঋণ নেওয়ার তালিকা রয়েছে। এসব লোকজন দালালদের প্রয়োলভনে পড়ে আইডি কার্ডের ফটোকপি দেওয়াতে তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁিড়য়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকে যাদের নামে ঋণ ইস্যু করা হয়েছে তাদের এনআইডির সামনের অংশ ভাসন্যাদম ইউনিয়নের পেছনের অংশ মাইনী ইউনিয়নের নাম রয়েছে। ব্যাংক ঋনের মধ্যে হাঁস মুরগি প্রকল্প, শস্য ঋণসহ ইত্যাদি প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে। এ দালাল চক্রে জড়িত রয়েছেন গাঁথাছড়ার হেলাল,মারিশ্যাচরের সেলিম,বাইট্টাপাড়ার জামাল, বাইট্টপাড়ার মিষ্টি কালামসহ বেশ রয়েছেন। সর্বশেষ ১২ বছর পর ২০২৩ সালে শেষের দিকে লংগদু সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ কর্মসূচির মেয়াদ উত্তীর্ন খেলাপী বকেয়া পরিশোধের চুড়ান্ত নোটিশ ভুক্তভোগী লোকজনরা হাতে পায় ঘটনাটি জানতে পারেন। আবার কারোর নামে একের অধিক ব্যাংক ঋণ রয়েছে। এসব ঋনের টাকা ২৫ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকার মধ্যে।
এদিকে, দালাল চক্রের মিষ্টি কালামসহ কয়েকজনকে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাদের মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে অপর চক্রের দালাল বগাতর ইউনিয়নের মারিশ্যাচরের বাসিন্দা মোঃ সেলিম জানান, তিনি গরীব ও লেখা পড়া জানেন না। তাই কিছু জানেন না। তবে একদিন পাশর্^বর্তী চাচার বাড়ীতে বেড়াতে গেছেন। সেখানে দেখা হয় বাট্টাপাড়ার মিষ্টি কালামের সাথে। তিনি তাকে কি কাজ করেন বললে কিছু করেন না জানান। এক পর্যায়ে মিষ্টি কামাল তাকে জানান, সোনালী ব্যাংক থেকে সরকারী অনুদান দিচ্ছে এনআইডি কার্ড দিতে। পরে তাকে তার ও স্ত্রী এনআইডি কার্ডসহ সোনালী ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে দুহাজার পায়। এরপর এ টাকা দিয়ে এলাকার বাজার করতে দেখে অন্যান্যরা বলে এত টাকা কোথায় পেয়েছেন। তিনি তাদের জানান সোনালী ব্যাংক থেকে সরকারী অনুদান পেয়েছি। এরপর তার গ্রাম থেকে এনআইডি কার্ড ১৩ থেকে ১৪ জনকে নিয়ে গিয়ে মিষ্টি কামালের কাছে। তারাও এক হাজার টাকা পেয়েছে। তবে এ কাজে তিনি মিষ্টি কালাম থেকে একশত থেকে দেড় টাকা পেয়েছেন।
অপরদিকে, রোববার ভুক্তভোগীরা লংগদু সদর উপজেলায় গিয়ে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন। এসময় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, দালাল চক্রটি সরকারী অনুদান দেওয়ার নামে গরীব ও অসহায় মানুষের আইডি কার্ড সংগ্রহ করে কার্ডের নাম পরিবর্তন করে ব্যাংক কর্মকর্তারা তাদের নামে মিথ্যা ঋণ উত্তোলন করেছেন। শুধু দুই ইউনিয়নে নয় গোটা লংগদু উপজেলায় এধরনের ব্যাংক ঋণ জালজালিয়াতি হয়েছে বলে ভুক্তভোগিদের দাবী। তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ মিথ্যা ঋণ থেকে মুক্তির দাবী জানিয়েছেন।
ভুক্তভোগী আইন উদ্দীন জানান, গেল বছর নভেম্বর মাসের শেষের দিকে আমাদের নামে যখন ঋণ পরিশোধের ইস্যুর নোটিশ করা হয়েছিল তখন আমরা ব্যাংকে গিয়ে ভাসন্ন্যা আদাম ও বগাচতর ইউনিয়নের অপাতত ৩০৪ জনের তালিকা দিয়েছে। বাকী তালিকা আমরা পায়নি। তবে আমরা খবর নিয়ে দেখেছি পুরো লংগদু উপজেলায় প্রায় সাড়ে আট শত মানুষের নামে ভুয়া ব্যাংক ঋন নেওয়া হয়েছে। যার সুদেআসলে ঋণের পরিমাণ ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা হবে তার ধারনা। তিনি আরো জানান, জালিয়াতী চক্রে ৮ সদস্যর একটি দালাল চক্র জড়িত রয়েছে। তাদের এনআইডি কার্ডের ফটোকপির সামনের অংশটি ভাসন্যাদম ইউনিয়নের পেছনের অংশটি রয়েছে মাইনী ইউনিয়নের। ঋণ পরিশোধের নোটিশ পেয়ে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি জানান, এ মিথ্যা ঋণ তার জীবনে কখনো পরিশোধ করবে না, প্রয়োজনে তিনি জেল খাটবেন। তিনি জানান, এ বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার, দুর্নীতি দমন কমিশন, সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সহ কয়েকটি স্থানে অভিযোগ জানানো হয়েছে।
ভুক্তভোগী মমতাজ উদ্দিন জানান, তিনি আনসারের চাকরি করেন। অথচ তার নামে ব্যাংক ঋণ রয়েছে। তার নামে ভূয়া স্বাক্ষর জাল করে ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে। তার মাসিক বেতন থেকে সোনালী ব্যাংক টাকা কেটে রাখা হচ্ছে। বৃদ্ধ আব্দুল ওদুদ মিয়া বলেন, তারা গাছ কেটে বাঁশ কেটে জীবন ধারন করে থাকেন। অথচ তাদের নামে দুই থেকে তিনটি ব্যাংক ঋণ রয়েছে। সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার একবারও খবর নিলো না এসব মানুষরা কোথায় থেকে, কেন ঋণ নিচ্ছে। ভুক্তভোগী ভাসন্যাদমের বিধবা কোহিনুর বেগম জানান, তার ভিক্ষা করে জীবন চলে। তার কোন নির্দিষ্ট বাড়ীঘর নেই। কিভাবে তিনি সোনালী ব্যাংক থেকে ঋন নিয়েছেন। অপর গৃহবধু শাহীনুর বেগম জীবনে একবারও সোনালী ব্যাংক দেখেননি, এমনি লংগদু সদরেও যাননি। তার স্বামী মাছ শিকার করে চার সন্তানকে নিয়ে পরের বাড়ীতে থাকেন। অথচ তার নামে ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা ব্যাংক থেকে ঋণের পরিশোধের নোটিশ দিয়েছে। তিনি কোন ঋণই নেননি কিভাবে দেবেনে?
এদিকে, সোনালী ব্যাংকের লংগদু শাখার ম্যানেজার মোঃ আবুল কাসেমের সাথে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কথা বলা যাবে না বলে দোহায় দিয়ে কথা বলতে অপরাগত প্রকাশ করেন। তবে সোনালী ব্যাংকের রাঙামাটি প্রিন্সিপাল শাখার সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার রফিকুল ইসলাম মুঠোফোনে জানান, এ বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে এবং উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত টিমের তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্তের স্বার্থে ও উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া এ বিষয়ে কোন কথা বলা যাবে না।
এ ব্যাপারে লংগদু উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল বারেক সরকারের কাছে জানতে চাইলে অনিয়মের বিষয়টি সত্য বলে জানিয়ে বলেন, যাদের নামে ঋণ নেওয়া হয় তাদের অধিকাংশ ভূমিহীন ও গরীব। কেউ ভিক্ষা করে খায়। কেউ দিন মজুর করে। স্থানীয় হেলাল,সেলিম, মিষ্টি কালাম নামে কয়েকজন দালাল এবং তৎকালীন ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে এ অনিয়ম হয়েছে। নিরীহ লোকজন যেন হয়রানীর শিকার না হয় বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখতে তিনি লংগদু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বলেছেন। তাছাড়া রাঙামাটি ও লংগদু সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তাদেরকেও তিনি বিষয়টি অবগত করেছেন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের ডিজিএম এর সাথে যোগাযোগ করেছেন। তিনি তাকে জানিয়েছেন বিষয়টি তদন্ত করা হবে। তদন্ত করে প্রকৃতপক্ষে ঋনের সংখ্যাটি কত তা সঠিকভাবে চিহিৃত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.