পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ২৬ বছরেও অধরা। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই হয়েছিল। কিন্তু পার্বত্য চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সেই কাক্সিক্ষত সমাধান এখনো অর্জিত হয়নি। তবে চুক্তির পরবতী পাহাড়ে যোগাযোগ,অবকাঠামো, পর্যটন শিল্প থেকে বিভিন্ন উন্নয়নমুলক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পেলেও মিলেনি শাসনতান্ত্রিক অংশীদারীত্ব। এ অবস্থায় শনিবার পার্বত্য চুক্তির ২৬ বছর পুর্তি উদযাপিত হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশী সময় ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাত অবসানের লক্ষ্যে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সই হয়। চুক্তি মোতাবেক ১৯৯৮ সালে জনসংহতি সমিতির তৎকালীন শান্তি বাহিনীর প্রায় দুই হাজার সদস্য সরকারের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। তবে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের ২৬ বছরে পাহাড়ের সড়ক যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়ন হলেও নিশ্চিত হয়নি এ এলাকার মানুষের শাসনতান্ত্রিক অংশীদারীত্ব। চুক্তির মৌলিক বিষযগুলোর মধ্যে ভ‚মি বিরোধ নিষ্পত্তি, প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, আইন শৃঙ্খলা, স্থানীয় পুলিশসহ ইত্যাদি বিষয়গুলো বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে এসব মৌলিক বিষয়গুলো বিষয়গুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায় পাহাড়ি-বাঙালী উভয় জনগোষ্ঠীর মাঝে জমে রয়েছে অসন্তোষ ও বিশ্বাস-অবিশ্বাস। চুক্তির ২৬ বছরেও পাহাড়ের মানুষকে এখনো চুক্তি বাস্তবায়নের দাবী আন্দোলন করতে হচ্ছে। পাহাড়ের অন্যতম সমস্যা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষে ২০০১ সালের ২০ জুনে গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি লক্ষে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করা হয়। তবে আইন সংশোধনের পরও এখনো ভূমি কমিশনের বিধিমালা তৈরী হয়নি। তিন বছর মেয়াদে এ পর্ষন্ত ছয়বার কমিশনের চেয়ারম্যান পরিবর্থন হলেও ভূমি বিরোধ সমস্যা সমাধানে কোন সফলতা মিলেনি। তিন পার্বত্য জেলা থেকে ভূমি বিরোধ নিয়ে সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রায় ২২ হাজার দরখাস্ত জমা পড়লেও নিষ্পত্তি হয়নি।
অপরদিকে, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও চুক্তি সম্পাদনকারী জনসংহতি সমিতির মধ্যে রয়েছে বির্তক। সরকারের দাবী পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে। সম্পাদনকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির দাবী ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। ১৮টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে, অবশিষ্ট ২৯টি ধারা সম্পূর্ণভাবে অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে।
জেএসএসের প্রকাশিত বুকলেটে দাবী করা হয়, চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি।সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন না করে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি উত্তরোত্তর জটিল থেকে জটিলতর হতে বসেছে। চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো আংশিক বাস্তবায়ন করে অথর্ব অবস্থায় রেখে দেওয়া হয়েছে। চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন সংক্রান্ত তিনটি ধারা যথাক্রমে ৪, ৫ ও ৬নং ধারা) রয়েছে। এই তিনটি ধারার মধ্যে সরকারের ভাষ্য অনুসারে ৪নং ধারাটি ‘আংশিক বাস্তবায়িত’, ৫নং ও ৬নং ধারা দুটিও ‘বাস্তবায়িত’ হয়েছে যা সঠিক নয়। বিগত ২৬ বছরেও একটি ভূমি বিরোধও নিষ্পত্তি হয়নি। গেল ৬ অক্টোবর ২০১৬ জাতীয় সংসদে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৬ পাশের মধ্য দিয়ে ১৫ বছর পর ২০০১ সালে প্রণীত ভূমিকমিশন আইনের বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করা হয়। আইন সংশোধনের পর ভূমি কমিশনের বিধিমালার খসড়া তৈরি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের তরফ থেকে ১ জানুয়ারি ২০১৭ ভূমি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার এখনো সেই বিধিমালা চুড়ান্ত করেনি। এর ফলে ভূমি কমিশনের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির বিচারিক কাজ এখনো শুরু করা যায়নি। এছাড়া ভূমি কমিশনের নেই পর্যাপ্ত তহবিল,জনবল ও পারি সম্পদ।
এদিকে, চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় ২৬ বছরে ৬টি আঞ্চলিক দলের সৃষ্টি হয়েছে। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য জনসংহতি সমিতি ও প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) নামের দুটি দল ছিল। পরবর্তীত জেএসএসের নেতা সুধাসিন্ধু খীসা ও রুপায়ন দেওয়ানের নেতৃত্বে জেএসএস (এমএন লারমা গ্রুপ) নামে আত্নপ্রকাশ ঘটে। এছাড়া গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ ও মগ পার্টি দলের অর্ভিভাব ঘটে। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) আরো একটি দলের জন্ম লাভ করে। আঞ্চলিক দলের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের কারণে কাংখিত শান্তির সুবাতাসও মিলছে না।
কলেজ ছাত্র সুনীতি চাকমা বলেন, পাহাড়ের স্থায়ী অধিবাসীদের নিরাপত্তা ও সার্বিক উন্নয়ন কথা থাকলেও পার্বত্য চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে তা হয়নি। আমরা চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো দ্রুত বাস্তবায়নের দাবী জানাচ্ছি।
সমাজ সেবক নূরুল আবছার বলেন, সরকার বলছে চুক্তির ধারাগুলো অধিকাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে বলছে। তবে অপর পক্ষ বলছে এখনো অনেকগুলো ধারা বাস্তবায়ন হয়নি। যদি অবাস্তবায়িত না হয়ে থাকে তাহলে সরকার ও চুক্তি সম্পাদনকারীদেরকে নিয়ে বসে চুক্তির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন করুক।
বিশিষ্ট নারী নেত্রী এ্যাডভোকেট সুস্মি চাকমা বলেন, ২৬ বছরে এসেও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। কারণ একটা চুক্তি ২৬ বছরের পর কি আর উপযোগীতা থাকতে পারে। পার্বত্য চুক্তির মুল বিষয়গুলোর মধ্যে ভূমি সমস্যা তা যথাযথভাবে কাজ করতে পারছে না, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিত্ব শীল প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে সেগুলো নির্বাচন না হওয়ায় গনতান্ত্রিক প্রনিধিনিত্ব করতে পারছে না ইত্যাদি বিষয় রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, এতদিন আমরা শুনেছি পার্বত্য চুক্তির ৭২ ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু শুনছি ৬৫ ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। কতটা ধারা বাস্তবায়িত হলো তা মুখ্য বিষয় নয়। গাণিতিক বিষয় নয়। আমরা চুক্তি বাস্তবায়নে গুনগত রেজাল্ট চাই। চুক্তিতে রয়েছে উপজাতীয় অধ্যষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকার করা। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতিও নেই নিশ্চয়তাও নেই। এছাড়া এ অঞ্চলে ভূমি অধিকার জেলা পরিষদ আঞ্চলিক পরিষদকে কাযর্যকর, ভারতপ্রত্যাগত ও অভ্যন্তরীন উদ্ধাস্তুদের পুর্ণবাসিত করা কিন্তু তা কোনটাই হয়নি। জেলা পরিষদ স্বায়ত্বশাসিত পরিষদ হলেও সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ করা হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে জেলা পরিষদগুলোকে নির্বাচন দেওয়ার কথা কথা তা হয়নি। সরকারের মনোনীত দলীয় লোকজন দিয়ে পরিচালনা করায় কোন জবাবদিহিতা নেই। ভারত প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২ পরিবার রয়েছে তারা দুইভাগের একভাগও জায়গাজমি ফেরত পায়নি। অভ্যন্তরীণ ৮০ হাজার পরিবার রয়েছে তাদের নুন্যতম রেশনও তারা পায়নি। তাই চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে আশা ব্যঞ্জক নয়। তার পডিরবর্তে নতুন নতুন করে সমস্যা তৈরী হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবী করতে করতে হয়রান। প্রধানমন্ত্রী আমাদের বিষয়ে সংবেদনশীল। আর যাতে বলতে না হয় চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন করে এলাকার স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
রাঙামাটির আসনের সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো যদি দুর করা না যায় তাহলে চুক্তি বাস্তবায়নে স্বাছন্দ্য গতি পাবে না। আমরা অকপটে স্বীকার করি চুক্তির যে মুল বিষয়গুলো ভূমি কমিশন, স্থাণীয় পুলিশ, বন ও পরিবেশ ধারাগুলো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি তা বাস্তবায়িত হওয়া দরকার। তবে বাস্তবায়নে প্রক্রিয়া চলছে। চুক্তি বাদবাকীগুলো মনে হয় ৬৮ কিংবা ৬৯ ধারা ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, বাস্তবতার প্রেক্ষিত যদি আমরা বুঝতে না পারি যে কোন মূল্য চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। বাস্তবায়ন করতে গেলে একটা দেওয়া-নেওয়া থাকতে পারে। তাই দেওয়া-নেওয়ার সমঝোতা বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে যদি না হয়, সিদ্ধান্ত ও বিচেনায় আনতে না পারি তাহলে ২৬ বছর পরেও অনেক বছর অতিক্রম করবে তারপরও শান্তি চুক্তির বাস্তবায়নমুখ আমরা দেখবা না।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.