শুক্রবার রাঙামাটিতে বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ ত্রিপিটকের বাংলা ভাষায় প্রথম পূর্নাঙ্গ গ্রন্থের অনুষ্ঠানিকভাবে মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে।
রাঙামাটির রাজ বন বিহার মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে ত্রিপিটকের মোড়ক উন্মোচন করেন বন বিহারের ভিক্ষু সংঘের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবির ও চাকমা রাণী ইয়েন ইয়েন।
বক্তব্যে রাখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের প্রধান প্রফেসর জিনবোধি মহাথের, জ্ঞানরত্ন মহাস্থবির, ত্রিপিটক পাবলিশিং সোসাইটির আহ্বায়ক শ্রীমৎ ইন্দ্রগুপ্ত মহাস্থবির, জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ড.আশরাফ আহমেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক দীলিপ কুমার বড়ুয়া।
এছাড়া অনুষ্ঠানে বোমাং সার্কেল চীফ রাজা সাচিং প্রু চৌধুরী, রাজ বিহার পরিচালনা কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান সাবেক উপমন্ত্রী মনিস্বপন দেওয়ান,বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক দীপেন দেওয়ান, জাতীয় মানবধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ানসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে তিন পার্বত্য জেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থান কয়েক হাজার বৌদ্ধ নারী-পুরুষ অনুষ্ঠানে শরীক হয়েছেন।
অনুষ্ঠান শুরুতে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট সংগীত রনজিত দেওয়ান। পরে পঞ্চশীল প্রার্থনা ও ত্রিপিটক উৎস্বর্গসহ নানাবিধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এর পর স্বাগত বক্তব্যে রাখেন ত্রিপিটক পাবলিশিং সোসাইটির সদস্য শিক্ষাবিদ মধুমঙ্গল চাকমা। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গকে প্রকাশিত বাংলা ভাষায় সমগ্র ত্রিপিটক গ্রন্থ বাংলাদেশ ত্রিপিটক পাবলিশিং সোসাইটি পক্ষ থেকে এক সেট করে ত্রিপিটক উপহার দেয়া হয়। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ত্রিপিটক সেট গ্রহন করেন রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা। এর আগে সকালে একই স্থানে পঞ্চশীল প্রার্থনা, অষ্টপরিস্কার দান ও ধর্মীয় আলোচনা সভার অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, ত্রিপিটকের যে শিক্ষা রয়েছে তা শুধু বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের জন্য নয় সমগ্র মানব জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ন। বাংলায় ভাষায় ত্রিপিটক প্রকাশের ফলে বাংলা ভাষাভাষির লোকজন বুদ্ধ ধর্মের যে নীতি ও আদর্শ রয়েছে তা ভালোভাবে জানতে পারবেন এবং বুদ্ধ ধর্মকে প্রকৃতভাবে উপলদ্ধি করার সুযোগ পাবে।
অনুষ্ঠানে জাহাঙ্গী নগর বিশ্ব বিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. আশরাফ আহমেদ বলেন, হাজার বছরে বাংলা ভাষায় ত্রিপিটক প্রকাশিত হয়নি। এটাই বাংলায় অনুবাদ করা প্রথম ত্রিপিটক। এ মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারায় তিনি নিজেকে খুবই গৌরান্বিত ও ইতিহাসের স্বাক্ষী রইলেন।
তিনি আরো বলেন, সুন্দর বাংলা ভাষায় ত্রিপিটক অনুবাদ করা হয়েছে এবং যে সাহিত্য ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা সাধারন মানুষ বুঝতে পারে সেভাবে অনুবাদ করা হয়েছে। আবার একটা ধর্ম গ্রন্থের যে মান বজায় থাকে তাও এই গ্রন্থে রয়েছে। কাজেই এই অসাধারন গুরুত্বপূর্ন কাজটি ত্রিপিটক পাবলিশিং সোসাইটি করেছে এবং শ্রদ্ধেয় বনভান্তের শিক্ষার ফলে এবং সুদুর প্রসারি চিন্তার ফলে বাংলা ভাষায় এ ত্রিপটক প্রকাশ লাভে সক্ষম হয়েছে।
তিনি আশা প্রকাশ করে আরো বলেন, এ ত্রিপটক শুধু বাংলাদেশের বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের নয় বাংলাদেশের বাঙালীদের কাছে জনপ্রিয় গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে।
ত্রিপিটক পাবলিশিং সোসাইটির আহ্বায়ক শ্রীমৎ ইন্দ্রগুপ্ত মহাস্থবির বলেন, ত্রিপিটক প্রকাশের সন্মিলিত প্রচেষ্টা সময়োপযোগী ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহনের মাধ্যমে এই প্রথম বাংলায় সমগ্র ত্রিপিটক প্রকাশ করে পরম পূজ্য বনভান্তের ইচ্ছা পরিকল্পনাকে পূরণ করে দিতে সমর্থ হয়েছি। তবে তার যদি ইচ্ছা ও পরিকল্পনা না থাকতো এটির প্রকাশনা করা সম্ভব হতো না।
তিনি আরো বলেন, এ ত্রিপিটক বাংলা ভাষায় প্রখাম করলেও এ অনুবাদের কৃতিত্ব আমাদের নয়। ত্রিপিটকটি নতুন করে অনুবাদ করিনি। যেগুলো অনুবাদ করা হয়নি সেগুলো আমরা অনুবাদ করেছি। এর আগে অনেক ত্রিপিটক অনুবাদিত হয়েছে। বাংলা প্রথম অনুবাদ হয়েছে ১৮৮৭ সালে সুত্তপিটক বই। যিনি অনুবাদ করেছেন ধর্মরাজ বড়ুয়া। এরপর ১৯১৬ সালে ঈশান চন্দ্র ঘোষ জাতক ৬ খন্ড বাংলায় অনুবাদ করেন। ১৯২৮ সালে প্রজ্ঞালোক মহাস্থবির সমগ্র ত্রিপিটক অনুবাদ করার এক মহৎ গ্রহনের জন্য মায়ানমারে রেঙ্গুনে বৌদ্ধ মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। তার এ উদ্যোগের প্রেক্ষিতে বাংলায় অনুবাদ ও প্রকাশ করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ সালে শক্তিশালী বোমার আঘাতে বৌদ্ধ মিশন প্রেস সম্পুর্ণরুপে ধ্বংস হয়। সেখানেই এ উদ্যোগ পরিসমাপ্তি ঘটে। তাই বাংলায় ত্রিপিটক অনুবাদের ইতিহাস ১০১ বছরের বলে ধরা যায়।
চাকমা রানী ইয়েন ইয়েন আশা প্রকাশ করে বলেন, ত্রিপিটক বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করায় রাজ বন বিহার বৌদ্ধ দর্শন প্রচার ও প্রসারে যে প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে সেই গতিশীলতা বজায় রেখে উত্তোরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি পাবে। তিনি বুদ্ধ ধর্মের যে দর্শন ও আদর্শ রয়েছে তার চর্চার মাধ্যমে সমাজের মানবিক চেতনায় উন্নতি হবে বলেও মন্তব্য করেন।
রাঙামাটি রাজ বন বিহারের ভিক্ষু সংঘের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবির সবাইকে সৎ কর্ম ও সৎনীতি নিয়ে কর্ম সম্পাদন করার হিতোপদেশ দিয়ে বলেন, ত্রিপিটক বাংলা ভাষায় প্রকাশের কারণে দেশের বৌদ্ধ সমাজের সুখ সমৃদ্ধি বা দুঃখ থেকে মুক্তির লাভের উপায় নিয়ে আসবে তা বলতে চাইছি না। এই ত্রিপিটক শাস্ত্রে যে ধর্ম উপদেশ বা শিক্ষা দেয়া হয়েছে তা যদি বুদ্ধের সৎকর্ম, সৎ নীতি আদর্শগুলো মেনে চলতে পারি তা হলে এর ফল শুভ হবে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.