পাহাড়ে জুম চাষীরা ভাল নেই। পাহাড়ের মাটি উর্বরতা হ্রাস, জুম পাহাড়ের জমি সংকূচিত হওয়া, উন্নত জাতের জুম ধানের বীজের অভাব ও অতি বৃষ্টিপাতের কারণে এ বছর জুমিয়ারা ভাল ফলন ঘরে তুলতে পারেননি। ফলে জুম চাষের উপর নির্ভরশীল জুমিয়ারা সারা বছরের খোরাকি নিয়ে বেশ চিন্তিত। রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রমনী কান্তি চাকমাও স্বীকার করেছেন জুম পাহাড়ের মাটি উর্বরতা কমে যাওয়াসহ কয়েকটি কারণে এ বছরে জুমে ফলন তেমন ভাল হয়নি।
জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের পাদদেশে গাছ-গাছালি কেটে আগুনে পুড়িয়ে জমিতে যে চাষ করা হয় তার নাম হচ্ছে জুম চাষ। জুম চাষ পাহাড়িদের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রথা হলেও এটি একটি জীবন জীবিকার উৎসও বটে। সাধারনত পৌষ-মাঘ (জানুয়ারী-ফের্রুয়ারী) মাসে পাহাড়ের ঢাল পরিস্কার করে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে আগুনে পুড়িয়ে মাটি উপযুক্ত করা হয়। এর পর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ(এপ্রিল-মে) মাসে পাহাড়ে বর্ষা শুরু হওয়ার পূর্বে সুঁচালো দা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে একসঙ্গে ধানসহ নানা সব্জির বীজ বপন করা হয় এবং শ্রাবণ-ভাদ্র (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসে জুমের ধান পেকে থাকে। জুমিয়ারা জুমে যেসব ধান রোপন করে থাকেন সেগুলো হল সোনালী, চিকন, রাংগী, তুর্কি, বাদেইয়া, বিনি, গেলং, কবরক, কামারাং, আমেই, সুরি, চড়–ই, মধুমালতি, ভুপ্প্ই, গুড়ি চিনেল,রেঙ্গই ইত্যাদি। এসব ধান স্বাদ ও গন্ধ আলাদা এবং সুগন্ধি এবং আঠালো হয়ে থাকে। জুম ধানের সাথে শাক-সব্জির মধ্যে ভূট্টা, মারপা, মরিচ, বেগুন, শসা, শিম, তিল, ঢেঁড়স, মিষ্টি কুমড়া, ঝিঙে, করলা, ফোরল, পাহাড়ি আলু, শাবারাং (এক প্রকার সুগন্ধিযুক্ত সবব্জি) জুমিয়া কচু বপণ করে থাকে। এছাড়াও জুম চাষীরা আর্থিক লাভের আশায় তূলা, হলুদ ও সত্রং ফূলের (গাঁদা ফূল) চাষ করা হয়।
তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে,এ বছর তিন জেলায় মোট ১৭ হাজার ৮১৮ হেক্টও জমিতে জুম চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে রাঙামাটি জেলায় ৬হাজার ৬১৫হেক্টর জমিতে জুম চাষ করা হয়েছে। এতে প্রতি হেক্টরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ দশমিক ২ মেট্রিক টন। খাগড়াছড়িতে ২ হাজার ২৭২হেক্টর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৫ হাজার ৫১৩মেঃটন এবং বান্দরবানে ৮ হাজার ৯৩৭হেক্টর জমিতে প্রতি হেক্টর ৪ দশমিক ১মেঃ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে।
২০১১ সালের এক তথ্যে দেখা গেছে অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১১টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে শতকরা ৮০ শতাংশ জুম চাষের উপর নির্ভশীল। পাচঁটি প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে চাকমা ২২ দশমিক ৭, ত্রিপুরা ৫৪ দশমিক ৮, মারমা ৪২ দশমিক ৩, ম্রো ৮৬ দশমিক ৪ এবং বাঙালী ১ দশমিক ৬ শতাংশ জনগোষ্ঠী জুম চাষের সঙ্গে জড়িত। সূত্র মতে, তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে অবস্থিত ৫ হাজার ৪৮০ বর্গকিলোমিটার অশ্রেনীভুক্ত বনভূমির সিংহভাগেই জুম চাষ করা হয়। পার্বত্য তিন জেলায় ৪০ হাজারের অধিক পরিবার এখনো জুম চাষ নির্ভর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। এর মধ্যে খাগড়াছড়িতে প্রায় ১৪হাজার, রাঙামাটিতে প্রায় ১২হাজার ও বান্দরবাসে প্রায় ১৪হাজার জুমিয়া (জুমচাষী) রয়েছেন। তবে বর্তমানে এ পরিসংখ্যান আরও কমে যেতে পারে।
এদিকে, রাঙামাটির মগবান ইউনিয়নের ব্যাঙছড়ি, চংড়াছড়ি,শিলছড়িসহ কয়েকটি স্থানে জুম চাষে সরেজমিনে ঘুরে গিয়ে দেখা গেছে, চাষীরা জুমের পাকা ধান ঘরে তোলা নিয়ে ব্যস্ত। এসব পাহাড়ের জুমিয়ারা জানান, গত বছরের চেয়ে এ বছর জুমের ফলন আশানুরুপ হয়নি। এ বছর অতি বৃষ্টি, জুম ধানের ফুল ফোটার মহুর্তে বৃষ্টি হওয়ায় জুম ধানের ফলন ভাল হয়নি। তারা আরও জানান, জুমের উন্নতমানের বীজের অভাব ছাড়াও কৃষি ঋণ না পাওয়ায় জমে সার প্রয়োগ করতে পানেনি। তাই ফলন ভাল না হওয়ায় সারা বছরের খোরাকি নিয়ে তারা চিন্তিত।
রাঙামাটির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রমনী কান্তি চাকমা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে মাটি দিন দিন উর্বরতা হ্রাস,জুমের জমি সীমিত হয়ে আসা, উন্নত জাতের বীজের অভাব, বীজ শোধন ও চাষীরা সুষম সার ব্যবহার না করায় এবং সর্বোপরী এ বছর অতি বৃষ্টিপাতের কারণে জুমের ফলন তেমন একটা ভাল হয়নি।
তিনি আরও বলেন, আগে একজন জুম চাষী জমিতে এক বার জুম চাষ করার পর ওই জমিতে ৫ থেকে ৬ বছর অনাবাদী রাখতো। বর্তমানে ১ বছর থেকে ২ বছর পর একই স্থানে জুম ধান চাষের কারণে মাটির উর্বরতা কমে যাওয়ায় ফলন কম হচ্ছে। তবে এ ক্ষতি পোষনের জন্য জুম চাষীরা অর্থকরী ফসল হিসেবে শাক-সব্জির মধ্যে ভূট্টা, মারপা, মরিচ, বেগুন, শসা, শিম, তিল, ঢেঁড়স ইত্যাদি বপন করে থাকেন। জুম ধানের ফলন ঘরে তোলার পর জমি পতিত না রেখে আয় বর্ধক ফসল হিসেবে লিচু, আম, পেয়ারসহ বিভিন্ন ফলজ বাগান করার জন্য জুম চাষীদের পরামর্শ দেন।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.