জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবলায়, জীববৈচিত্র্য প্রাকৃতিক পরিবেশ,বনজ সম্পদ রক্ষা,পানির উৎস ধরে রাখতে পার্বত্য চট্টগ্রামে গ্রামীণ সাধারণ বন(ভিসিএফ) বা ভিলেজ কমন ফরেষ্ট গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখে চলেছে। ইতোমধ্যে তিন পার্বত্য জেলায় ৩শ ১৪টি ভিসিএফ স্থাপিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনগোষ্ঠী স্বরণাতীতকাল থেকে তাদের প্রথাগত রীতি-নীতি, নিজস্ব উপায় ও পদ্ধতিতে গ্রামের আশা-পাশের বনের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থপনা করে আসছে পাহাড়ের গ্রামীণ সাধারন মানুষ। এই বন ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াকে প্রকারভেদে মৌজা বন, রিজার্ভ বনকে গ্রামীণ সাধারন বন বা ভিলেজ কমন ফরেষ্ট (ভিসিএফ) বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই গ্রামীণ সাধারণ বন তিনটি স্তরের মধ্যে প্রথম স্তরে রয়েছে নানান স্তরের লতাগুল্মসহ বহুবিধ বনঔষুধি ও ছোট ছোট গাছপালা, দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে মাঝারি আকারের গাছ-গাছালি এবং তৃতীয় স্তরে রয়েছে বড় বড় শতবর্ষীয় গাছপালা। গ্রামীণ সাধারণ বন থাকার কারণে ঝর্না বা ছড়ার পানি সারা বছর সচল থাকে এবং পশুপাখি ও বন্য জীব জন্তুদের খাদ্যর উৎস ও নিরাপপদ আবাসস্থল হিসেবে পরিণত হয়েছে। এই ভিসিএফ সম্পূর্ন পরিচালিত হয় প্রথাগত রীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করে গ্রামের লোকজনের সন্মিলিত ব্যবস্থাপনায়। তাই ভিসিএফ এলাকায় জুম চাষ ও বন্য প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ, বানিজ্যিক উদ্দেশ্য কাঠ বাঁশ ও অন্যান্য বনজ সম্পদ সংগ্রহ না করা। তবে এই বনজ সম্পদ সমষ্টিগতভাবে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও গ্রামবাসীদের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি, গ্রামবাসীদের নানান ধর্মীয় বিশ্বাস, পূজা অর্চনা ও নানান আনুষ্ঠানিকতার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের উৎস হচ্ছে এই ভিসিএফ। তাছাড়াও ভিসিএফ বনগুলো সম্মিলিতভাবে গ্রামের সবাইয়ের অংশ গ্রহনের ভিত্তিতে ব্যবস্থাপনা করায় গ্রামের সার্বিক শান্তি-শৃংখলা সুরক্ষা ও সামাজিক দ্বন্ধ নিরসনের বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
সূত্র মতে, ১৯৬৫ সালের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সময় মৌজা সার্ভিস সংক্রান্ত আদেশ নামে আদেশ ৮ এ ডিপুটি কমিশনার কার্যালয় পার্বত্য চট্টগ্রাম মেমো নং ২৩৮৪ (৪০) ৩ আগষ্ট ১৯৬৫, তৎকালীন ডিপুটি কমিশনার এস.এম.রহমান স্বাক্ষরিত এক আদেশে প্রতিটি মৌজার কমপক্ষে একটি করে ভিসিএফ (যার আয়তন আনুমানিক কমপক্ষে একশ একর) সংরক্ষন রাখার নির্দেশ জারি করেন। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৯০০সালের শাসনবিধি আইনের ৪১ এ ধারার প্রথাগত প্রতিষ্ঠান বা মৌজা হেডম্যান মৌজার প্রাকৃতিক সম্পদ ও বনজ সম্পদ রক্ষা ও ব্যাবস্থাপনা করার অধিকার প্রদান করা হয়েছে। যদিও এই ভিফিএফকে এখনো আইনী স্বীকৃতির আওতায় আনা হয়নি।
বেসরকারী উন্নয়ন সংস্তা শাইনিং হিল সুত্রে জানা গেছে, রাাঙামাটি,খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের তিন পার্বত্য জেলায় মোট ৩১৪ টি ভিসিএফ রয়েছে। এর মধ্যে রাঙামাটিতে ১২৯, খাগড়াছড়িতে ৭৫ ও বান্দরবানে ১১০টি। এসবের মধ্যে সার্কেল অনুযায়ী মং সার্কেলে ৫৫, বোমাং সার্কেলে ১১৭ টি ও চাকমা সার্কেলে ১৪২ টি ভিসিএফ রয়েছে। এসব ভিসিএফ প্রথাগত হেডম্যানের (মৌজা প্রধান) একটি কমিটির মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা ও পরিচালিত হয়ে থাকে।
রাঙামাটির বালুখালী ইউনিয়নের কাইন্দা ও বসন্ত মৌজার অর্ন্তভূক্ত ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত ৩০ একর জায়গায় বাদলহাট ভিসিএফ-এ সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চাকমা ও পাংখোয়া দুটি সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীরা সম্মিলিতভাবে একটি কমিটির মাধ্যমে নিজেরাই ভিসিএফ এর ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করছেন। তবে বর্তমানে ইউএসএআইডি-ইউএনডিপির অর্থায়নে সিএইচটিডিএফ-ইউএনডিপি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের যৌথ প্রকল্প এসআইডি-সিএইচটি এর আওতায় সিএইচটিডব্লিওসিএ-এর মাধ্যমে স্থানীয় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা শাইনিং হিল ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ভিসিএফ প্রকল্প নামে রাঙামাটি জেলায় মোট ১৮টি ভিসিএফ এর উন্নয়নে মাঠ পর্যায়ে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়নকারী সংস্থা শাইনিং হিল কমিউনিটি পর্যায়ে ভিসিএফ সংরক্ষণ ও এর ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সক্ষমতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিযোজন বিষয়ক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি সম্পর্কিত কর্যক্রমসহ ভিসিএফ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা ও এর সক্ষমতা বৃদ্ধি বিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই ভিসিএফে নানান জাতের গাছগাছালি ছাড়াও জীববৈচিত্র্যর সমাহার দেখা মিলেছে। সরেজমিনের সময় ভিসিএফের পরিচালিত বাদলহাট এলাকায় একটি গুহায় বাদুড়ের অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। এতে গুহায় প্রায় লক্ষাধিক বাদুড় রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
বাদলহাট ভিসিএফ প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের মধ্যে সলাই পাংখোয়া, তমতে পাংখোয়া,জোয়ামা পাংখোয়া, জৌরিন পাংখোয়াসহ অনেকের সাথে কথা বলে জানা যায়,বাদলহাট ভিসিএফের পাংখোয়া পাড়ায় ২৯ পরিবার ও এগজ্যাছড়ি পাড়ায় ১১৬টি পরিবার রয়েছে। এসব পরিবার নিজেদের প্রয়োজনে জ্বালানী কাঠ, ঔষুধী গাছ, শাক-সবজী এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবহারের জন্য বাঁশ-গাছ সংগ্রহ করে থাকেন। তারা আরো জানান, বাদলহাট ভিসিএফে জীবিৈচত্র্যর মধ্যে একটি এলাকায় লক্ষ লক্ষ বাদুরের অবস্থান রয়েছে। তাছাড়াও এ ভিসিএফে জারুল,গামারি,চাপালিশ,গর্জন,কড়ই,শিল কড়ই সহ নানান জাতের বাঁশ রয়েছে। জীব বৈচিত্র্যর মধ্যে রয়েছে টিয়া,বুলবুলি,শালিক, ভিমরাজ,এটদাগা,সট্টাপেক, ময়না,ঘুঘু, হরিণ,বন্য শুকর,বানর,সজারু,সাপ,বন বিড়াল,গুই সাপ,ভাল্লুক,মেছো বাঘ ইত্যাদি। বন ঔষধী বৃক্ষের মধ্যে বহেরা,হরিতকী,আমলকী,নিম ইত্যাদি রয়েছে। এছাড়া ভিসিএফ থাকার কারণে এলাকায় সারা বছর ছড়ার পানি থাক।
বাদলহাটের ভিসিএফ পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপত্ওি বসন্ত মৌজার হেডম্যান চিয়ালজল পাংখোয়া জানান, শাইনিং হীলের বাস্তবায়নাধীন বাদলহাট ভিসিএফ প্রকল্পের তার বসন্ত পাংখোয়া পাড়ায় ২৮ পরিবার সুবিধাভোগী রয়েছে। এসব পরিবার ভিসিএফ থেকে গাছ,বাশ ছাড়াও বন ঔধুধী ও ফলমুলসহ নিত্য বাবহার্য্য চাদিহা মেটাচ্ছেন। তিনি আরো জানান, এই প্রকল্প ছাড়াও পাংখোয়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আরো ৪শ একর গ্রামের সংরক্ষিত বন রয়েছে।
বাদলহাটের ভিসিএফের সভাপতি ও দোছড়ি পাড়ার কারবারী(গ্রাম প্রধান) প্রেমলাল চাকমা, ভিসিএফ থাকার কারণে এলাকায় জীবিৈচত্র্য রক্ষা পাচ্ছে ও ঝিরি বা ছড়া থেকে নিয়মিত পানি পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া এই ভিসিএফ থেকে গাছ,বাশ ছাড়াও লাকড়িসহ নিত্যবাহার্য্য বনজ সম্পদ পাচ্ছি।
শাইনিং হিলের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আলী জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে যেসব ভিসিএফ ঠিকে আছে তা স্থানীয় জনগোষ্ঠির সম্পৃক্ততায় সংরক্ষণ করা নাহলে ধীরে ধীরে এইসব ভিসিএফ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই ভিসিএফ সমূহ সংরক্ষণ ও নতুন নতুন ভিসিএফ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে একে কাজে লাগানো এবং পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুকি মোকাবেলায় এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় বলেন, স্থানীয় গ্রামীণ জনগনের সম্পৃক্ততা, ব্যবস্থাপনা ও পৃষ্ঠাপোষকতায় ভিসিএফ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। যদিও ইউএনডিপি’র মাধ্যমে সরকারী পৃষ্ঠাপোষকতায় কিছু কিছু এলকায় প্রকল্পের মাধ্যমে এই কাজ করা হচ্ছে। কিন্তু পার্বত্য এলাকায় আরো অনেক স্থানে এরকম প্রথাগত কায়দা গ্রামীণ বন সংরক্ষন করলেও এখনো সেগুলো তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করা হয়নি।
তিনি আরো জানান,ভিসিএফ এর সাথে যারা জড়িত তারা গ্রামীণ সাধারন শ্রেনীর মানুষ। ভিসিএফের কারণে গ্রামবাসীরা জুম চাষ,বাগান ও বসতি না করে তাদের স্বার্থকে ছেড়ে দিচ্ছে। তাই সরকারীভাবে তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা উচিত। এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, জেলা পরিষদসহ বিভিন্ন সংস্থা তাদেরকে সহযোগিতা করতে পারে। কারণ এই ভিসিএফের মাধ্যমে জীবিৈবচিত্র্য রক্ষা ও পনি সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.