দপ্তরির হাতে থাকা ঘন্টাটি ঢং ঢং করে বেজে উঠতে না উঠতেই বই হাতে শিক্ষার্থীরা দৌঁড়ে কাশ রুমে গিয়ে বই রেখে এ্যাসেম্বিলিতে সারিবদ্ধভাবে দাড়িঁয়ে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন এবং শেষে কাশ রুমে গিয়ে পাঠ্যবই খুলে জ্ঞান অর্জন করছে। এ যেন গ্রামবাসীর নিরলস প্রচেষ্টার সুফল। এটি রাঙাগামাটির জুরাছড়ি উপজেলার দূর্গম মৈদং ইউনিয়নের ফকিরাছড়ি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কথা। এই ইউনিয়নে শুধু মাত্র এই নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় জ্ঞান অর্জন করতে পারছে শিক্ষার্থীরা।
জানা গেছে, ফকিরাছড়া গ্রামের বাসিন্দা কালো কেতু চাকমা’র দান করা এক একর ভুমির উপর শুধু মাত্র টিনের চালের ছাউনির নীচে বসেই ২০০৪ সালে মাত্র ১৩জন শিক্ষার্থী নিয়ে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। সেই সময় প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ফেনু কাব্বারী, ২০১১ সালে রাঙাগামাটির সাংসদ দীপংকর তালুকদার এমপি তহবিল গঠনে এক লক্ষ টাকা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ এক কালীন ২০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান দেন। এছাড়া প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত স্কুলের সভাপতি থাকাকালীন ১৩৮নং মৈদং মৌজার হেডম্যান সম্রাট চাকমা’সহ অনেকেই এই বিদ্যালয়টি চালু রাখতে আর্থিক সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন। বর্তমানেও প্রতিমাসে ফকিরাছড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করে যাচ্ছে। পরবর্তিতে ২০০৮ সালে সেখানকার জনপ্রতিনিধি বরুন তালুকদারের সহযোগিতায় এডিপি প্রকল্প হতে বিদ্যালয়টি টিন শেড দিয়ে নির্মান করে দেওয়া হয়। বর্তমানে ৮জন শিক্ষক, ১জন শিক্ষিকা ও ১জন কর্মচারী এবং ১৫জন স্কুল পরিচালনা কমিটির দ্বারা ৩৫জন শিক্ষার্থী নিয়েই চলছে বিদ্যালয়ের পাঠদান।
অভিভাবকেরা জানান, এই পুরো ইউনিয়নে এই মাধ্যমিক স্কুলটি হওয়ায় আমাদের ছেলে-মেয়েরা মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে। সামান্য চাষাবাদ করে যা অর্থ পাই তাতে সাংসারিক খরচ মিটিয়ে আমাদের ছেলে মেয়েদের এই স্কুলে পড়াতে পারছি। এই বিদ্যালয়টি যদি না থাকতো তাহলে পাশ^বর্তী ইউনিয়ন, সদর উপজেলা বা শহরে আমাদের ছেলে-মেয়েদের অনেক টাকা ব্যয় করে পড়াতে হতো যা আমাদের পক্ষে খরচ চালানো সম্ভব হতো না।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লাল কুমার চাকমা বলেন, প্রত্যান্ত এবং দূর্গম এই এলাকার শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে এই বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিই। যতটুকু সম্ভব শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করবো। তিনি বলেন, পাঠদানের অনুমতি ও এমপিওভুক্তি করনের লক্ষ্যে শিক্ষা বোর্ডে অনেকবার পত্র প্রেরন করা হলেও অদ্যাবধি দেখেনি কোন আলোর মুখ। তবে আমি আশাবাদী আমাদের স্বপ্ন একদিন পূরণ হবেই।
তিনি আরো বলেন, ২০১৯সালে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড হতে সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক ইশরাত আরা বেগম এই স্কুলটি পরিদর্শন শেষে কিছুটা আশার বাণী দিয়েছিলেন তিনি । তাই বুকভরা আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে মৈদং ইউনিয়নবাসী।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বিশ্বকর্মা চাকমা ও জুয়েল চাকমা জানান, দূর্গম এই এলাকার ছেলে-মেয়েদের কথা চিন্তা করে সহকারী শিক্ষকের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে এবং নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছি। তারা বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা সময়মতো বেতন দিতে না পারায় সহকারী শিক্ষকদের সম্মানী দিতে প্রধান শিক্ষকের হিমশিম খেতে হয়। তারপরও আমরা আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। কারন আমরা চাই এই এলাকার ছেলে-মেয়েরা শিক্ষিত হয়ে মানুষর মতো মানুষ হোক।
মৈদং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও ১৩৫নং মৌজার হেডম্যান এবং ২০১৫সাল হতে অদ্যাবধি বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি সাধনা নন্দ চাকমা বলেন, দূর্গম এই ইউনিয়নের ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার কথা চিন্তা করে এই বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়। সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পারি সহযোগিতা করে যাচ্ছি ভবিষ্যতেও করবো।
তিনি আরো বলেন, এই এলাকার মানুষের জীবিকার একমাত্র উৎস কৃষিকাজ। এখানকার মানুষ নিজ বা অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে যতটুকু অর্থ পায় তা দিয়েই সাংসারিক খরচ ও ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছে। তাই এই স্কুলটি যদি এমপিওভুক্তির আওতায় আনা হয় এখানকার ছেলে-মেয়েরা উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ লাভ করবে।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার শিক্ষাবান্ধব সরকার। তাই দূর্গম এই ইউনিয়নের এই একটি মাত্র নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টিকে সু-নজরে এনে এমপিওভুক্তি করে এখানকার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উপকৃত করবে এই আশা রাখছি। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, জেলা পরিষদ’সহ অন্যান্য উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলো এই বিদ্যালয়টিতে সুনজর দেওয়ারও আবেদন জানান তিনি।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.