করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া রাঙামাটির প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র ও অসহায় লোকজন এখনো সরকারী ত্রান সহায়তা পায়নি। পাশাপাশি এসব প্রত্যন্ত এলাকার লোকজন সরকারের ১০ টাকা ক্রয়ে চাউল এবং মোবাইল ফোন ও অ্যাকাউন্ট না থাকায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ২৫০০ টাকার প্যাকেজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় ও অন্যতম সামাজিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি,পার্বত্য চট্টগ্রাম হেডম্যান নেটওয়ার্কসহ দশটি সংগঠনের পক্ষ থেকে যৌথ এক বিবৃতিতে এই অভিযোগ করা হয়েছে।
অন্য সংগঠনগুলো হল পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন,পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী হেডম্যান ও কার্বারি নেটওর্য়াক,বাংলাদেশ ইন্ডিজেনাস পিপলস নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড বায়োডাইভারসিটি (বিপনেট),বম সোশ্যাল কাউন্সিল,তৃণমূল উন্নয়ন সংস্থা,মালেয়া ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল (বিএমএসসি) ও ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, বাংলাদেশ।
নিম্নে বিবৃতির সম্পূর্ন অংশ দেয়া গেল---
আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক সংগঠনসমূহের পক্ষে নিম্নে স্বাক্ষরকারীগণ চলমান কোভিড-১৯ সংকটের মোকাবিলায় খাদ্য দ্রব্যের ত্রাণ, ১০ টাকায় চাল ক্রয়ের সুবিধা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পরিবার পিছু প্রদত্ত ২৫০০ টাকার বিশেষ প্যাকেজ সম্বলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করায় মাননীয় জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে অভিনন্দিত করছি ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
তবে, সরকারের গৃহিত প্রশংসনীয় এ ত্রাণ কার্যক্রম সত্ত্বেও মাঠ-পর্যায়ে সৃষ্ট কতিপয় সমস্যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের খাদ্য নিরাপত্তার চাহিদা পূরণ হতে পারেনি।
প্রথমত, পার্বত্য অঞ্চলের প্রত্যন্ত ও আধা-প্রত্যন্ত এলাকার একটা ক্ষুদ্র অংশের কিছু কিছু পরিবার সরকারি ত্রাণের চাল মোটেই পায়নি। আবার এ সব এলাকার বৃহত্তর অংশে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে পরিবার পিছু ১০ কেজি চাল দেয়া হলেও তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছিল মাত্র একবারই। তিন জেলা ও উপজেলা সদরের বাইরে কদাচিৎ ১৫-২০ কেজি চাল বিতরণ হতে দেখা গেছে। পরিবার পিছু দৈনিক ২ কেজি চালের চাহিদার বিপরীতে প্রদত্ত বরাদ্দ নিতান্তই অপ্রতুল ছিল।
দ্বিতীয়ত, পার্বত্য এলাকায় পণ্য পরিবহণ ব্যয়বহুল, অথচ ত্রাণ পরিবহণে ব্যয় বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। ফলে ত্রাণের একাংশ নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিক্রি করে অবশিষ্টাংশ তালিকাভূক্ত কিছু পরিবারকে বাদ দিয়েই বিতরণ করা হয়। আবার তালিকাভূক্ত পরিবারের সংখ্যা ঠিক রাখা হলে ত্রাণের পরিমাণ ১০ কেজি থেকে কমে গিয়ে হয় ৫ কেজিরও কম। বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের ৫টি গ্রামে পরিবার পিছু চাল পেয়েছে ২ কেজিরও কম।
তৃতীয়ত, জেলা ও উপজেলা সদরে ১০ টাকায় চাল বিক্রয়ের সুবিধা সদর সংলগ্ন গ্রাম/মহল্লার ৫-১০% পরিবার পেলেও প্রত্যন্ত ও আধা প্রত্যন্ত এলাকার ৯০%-এর বেশি পরিবার ঐ সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকেছে মর্মে জনশ্রুতি রয়েছে।
চতুর্থত, পার্বত্য চট্টগ্রামের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ জাতীয় পরিচয় পত্র এবং/ অথবা মোবাইল ফোন ও অ্যাকাউন্ট না থাকা বা স্ব স্ব পরিচয়পত্রে লেখা নামে মোবাইল সিম কিনতে বা রেজিস্ট্রেশন করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ২৫০০ টাকার প্যাকেজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে তালিকায় অন্যায়ভাবে বাদ পড়ে যাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
ইতিমধ্যে কোরোনা পরিস্থিতি ১০০ দিন অতিক্রম করেছে,আগামীতে আরও ১০০ দিন যে এ অতিমারীর প্রাদুর্ভাব থাকবেনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
তাই আমরা মনে করি, উপরে বিবৃত বিষয়গুলোর আলোকে উপরোক্ত ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা জরুরি।
তাছাড়াও, প্রত্যন্ত এলাকার মানুষেরা শুধু ত্রাণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত নয়, তারা বিদ্যুৎ সুবিধা, সুপেয় পানির অধিগম্যতা, উচ্চমানের শিক্ষা, সরকারি স্বাস্থ্য সেবা সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সেবা থেকে পুরোপুরি অথবা বহুলাংশে বঞ্চিত থাকায় তাদের জন্য এ সব সুযোগের সম্প্রসারণ সহ স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন অর্জনের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
আমরা আরও মনে করি, পার্বত্য অঞ্চলের বিশেষ কিছু দিক আমলে না নিলে এখানে ত্রাণের যথাযথবিতরণ, এবং মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই আগামী দিনের ত্রাণ কিংবা আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রমে অন্যান্যের মধ্যে নিম্নলিখিত অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও সমভাবে বিচেনায় রাখা জরুরি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারিভাবে চিহ্নিত ৯০ হাজারের বেশি পাহাড়ি আভ্যন্তরীন উদ্বাস্তু পরিবার স্থায়ীভাবে, এবং দীর্ঘমেয়াদে টাস্কফোর্স কর্তৃক পুনর্বাসিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের জন্য ভারত প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণার্থী ও গুচ্ছগ্রামবাসী বাঙালিদের অনুরূপ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক খাদ্যদ্রব্য বা তার সমপরিমাণ অর্থ প্রদান, সরকারিভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ, প্রাথমিক শিক্ষা, পানীয় জলের সুবিধা, মৌলিক চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং সেই সাথে স্ব স্ব বাস্তুভিটাতে তাদের প্রত্যাবর্তন ত্বরান্বিত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন কর্তৃক অগ্রাধিকারভিত্তিতে তাদের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা;
পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বসবাসরত পরিবারসমূহের ভূমি-মালিকানাসহ অন্যান্য ভূমি অধিকার অস্বীকৃত থাকায় তারা মানবেতর জীবন যাপন করে যাচ্ছে;
এ অঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকার পরিবারদের একটা বড় অংশ জুম চাষীদের মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার খাদ্যাভাব রয়েছে, যার তীব্রতা বর্ষায় বেশি। তার উপর এ এলাকারবাজার থেকে চাল ও অন্যান্য পণ্য ‘হেডলোডে’ করে নিয়ে যেতে কেজি প্রতি ১০-৩০ টাকা খরচ করতে হয় যা তাদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ তুল্য;
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও আরও অন্যান্য এলাকার শিল্প-কারখানায় কর্মরত পার্বত্য চট্টগ্রামের আনুমানিক ৫০ হাজার পাহাড়ি কর্মীদের যে একটি বিরাট অংশ চাকুরিচ্যুত কিংবা কোভিড-১৯ এর কারণে নিজ গ্রামে ফিরে আসায় বেকার হয়ে আছেনতাদের জন্য সরকারসহ বিজিএমইএ, বিজিপিএমএ, এফবিসিসি কর্তৃকস্বল্প মেয়াদে ত্রাণ প্রদান ছাড়াও তাদের কর্মসংস্থানসহ বিশেষ ভাতা প্রদানের উদ্দেশ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
যৌথ বিবৃতি দাতা সংগঠনসমূহ-
১. রাজা দেবাশীষ রায়, চাকমা রাজা, রাজবাড়ি, রাঙ্গামাটি
২. পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন
৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি
৪. পার্বত্য চট্টগ্রাম হেডম্যান নেটওয়ার্ক
৫. পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী হেডম্যান ও কার্বারি নেটওয়ার্ক
৬. বাংলাদেশ ইন্ডিজেনাস পিপলস নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড বায়োডাইভারসিটি (বিপনেট)
৭. বম সোশ্যাল কাউন্সিল
৮. তৃণমূল উন্নয়ন সংস্থা
৯. মালেয়া ফাউন্ডেশন
১০. বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল (বিএমএসসি)
১১. ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, বাংলাদেশ- এর পক্ষে
১. মি: সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা
সাধারণ সম্পাদক,
পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন।
২. মি: গৌতম দেওয়ান
সভাপতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি।