একাডেমিক ভবন, নিরাপত্তা বেষ্টনী, আর্থিক, প্রয়োজনীয় আসবাপত্র, উপকরণ ও সরঞ্জামাদিসহ নানা সঙ্কটে রাঙামাটি চারুকলা একাডেমী। নেই কোনো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। এসব নানা সঙ্কটের মধ্যে জেলার অন্যতম এ নৃত্য-সঙ্গীত-চারুকলাশিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত ও নৃত্য শিক্ষায় প্রতিষ্ঠানটির অবদান বিশাল। কিন্তু নেই কোনো সরকারি সহায়তা। প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় তুলে ধরে।
জানা যায়, সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে ‘ রাঙামাটি চারুকলা একাডেমী’ নামে পার্বত্য অঞ্চলে প্রথম এ চারুশিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথিতযশা চারুশিল্পী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। যার অঙ্কিত চিত্র কথা বলে জীবন্ত আর হার মানায় যে কোনো আলোকচিত্রকে। তিনি ছবি আঁকা শিখেছেন নিজেই। একাডেমিক কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অঙ্কন শেখেননি তিনি। কাজে লাগিয়েছেন, কেবল নিজের মেধা ও প্রতিভাকে। পরে রাঙামাটি শহরের কাঁঠালতলী এলাকার নিজের ১০ শতক জমিতে নির্মাণ করেন তার চারুকলা শিক্ষাপ্রষ্ঠিানটির স্থাপনা। এতে তার হাতেখড়িতে শিক্ষালাভের সুযোগ হয়েছে, রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলার বহু শিক্ষার্থীর।
কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, শুরু থেকে এ পর্যন্ত অসংখ্য শিক্ষার্থীর শিক্ষালাভসহ আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির শতাধিক শিক্ষার্থী। জাতিসংঘের লোগো এঁকে পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন, রাঙামাটি চারুকলা একাডেমির ছাত্র রিবেং চাকমা। আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন, সুনীতি জীবন চাকমাসহ বেশ কয়েকজন। জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে প্রায় একশ’ জন। কিন্তু এতকিছুর গৌরব ও বিশাল অবদান রেখেও জেলা শহরে অবস্থিত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি গত ৪০ বছর ধরে রয়েছে সম্পূর্ণ অবহেলায়। সরকারের নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, মূল্যায়ন ও সম্মাননা। প্রতিষ্ঠানটি পদির্শন করেছেন, দেশী-বিদেশী বহু ক্ষমতাসীন ব্যক্তি, কর্মকর্তা ও জ্ঞানী-গুণীজন। অথচ সহায়তার হাত বাড়াননি কেউ। তবু অবিচল পথচলায়- যদিও বর্তমানে চরম সঙ্কটের মধ্যে পরিচালিত হচ্ছে, একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে শেখানো হয় ছবি আঁকা, সঙ্গীত ও নৃত্য। সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন শ্রেণির ছোট শিশুরা শিখছে চারুকলা, সঙ্গীত ও নৃত্য।
প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যার জন্ম ১৯৪১ সালের মে মাসে জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার কুতুবদিয়া মৌজার বড়পাড়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। ২০০৭ সালে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য মনোনীত হয়ে দায়িত্বে ছিলেন, দুই বছরের অধিক। তিনি বলেন, নিজের ভাবনাহীনতায় সরকারি এমই স্কুলের পর পড়ালেখার সমাপ্তি ঘটে, যদিও বাবার ছিল আর্থিক স্বচ্ছলতা। কিন্তু চারুকলায় আমার যে শৈল্পিক নৈপুণ্য ও পরদর্শিতা তা মনুষের জন্য কাজে লাগাতে জায়গা-জমি সম্পদসহ সবকিছু দিয়ে সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে রাঙামাটি চারুকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেছি। শুরু থেকে নিজেই শিক্ষা দিয়ে আসছি, এলাকার অসংখ্য শিক্ষার্থীকে। স্বেচ্ছাশ্রমে পরিচালনা করছি প্রতিষ্ঠানটি। শিক্ষা দেয়া ছাড়াও ঝাড়– দেয়া থেকে শুরু করে সব কাজগুলো করি নিজেই। বর্তমানেও বিভিন্ন শ্রেণিতে পড়–য়া দুই শতাধিক শিশুশিক্ষার্থী চারুকলা, সঙ্গীত ও নৃত্য শিখছে। এসবে শিক্ষাদানের জন্য আমার পাশাপাশি ১১ শিক্ষক স্বেচ্ছায় কাজ করছেন। আমার ছাত্র হিসেবে শিক্ষাদানে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন তারা। তাদেরকে কোনো বেতন দিতে পারি না। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যৎ সমান্য ফি নেয়া হয়। সেগুলো দিয়ে টুকিটাকি খরচগুলো মেটে না। কীভাবে শিক্ষকদের বেতন দেই ? সরকার থেকে পাঁচ টাকাও পাইনি, পৃষ্ঠপোষকতা তো দূরের কথা।
তিনি বলেন, একাডেমিক ভবনের সংকুলান না হওয়ায় এবং প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, উপকরণ ও সরঞ্জামাদি না থাকায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে খুবই সমস্যা। রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে একটি সম্প্রসারিত ভবন করে দেয়া হচ্ছে, কিন্তু সেটিও অসমাপ্ত। কাজ বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন। তার কারণ কী, তা জানা নেই। রক্ষণাবেক্ষণে নিরাপত্তা বেষ্টনী বা বাউন্ডারি দেয়াল নেই। বখাটেরা সব সময় ঢিল মেরে ভবনের বিভিন্ন স্থানে ফুটো করে দেয়। এতে আমরা সবাই নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকি। অনেক কষ্ট করে ছোট ছোট শিশুরা শিখতে আসে। অথচ তাদের পর্যাপ্ত কোনো সুযোগ-সুবিধার সহায়তা নেই। ভারতে বনের বানরদের জন্য বরাদ্দ থাকে। কিন্তু আমার প্রতিভাবান কচিকাচার শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার সহায়তায় পাঁচ টাকার সরকারি সহায়তা মেলে না। এর চেয়ে আর কী বলার থাকে ? আমরা তো হাতী চাই না। চাই কিছুটা আন্তরিক সহায়তা।
রাঙামাটি চারুকলা একাডেমী পরিচালনা কমিটির অন্যতম সদস্য অভীক কুমার তঞ্চঙ্গ্যা ও শিক্ষক সৌরভ তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, এতকিছু অবদান থাকার পরও আমাদের প্রতিষ্ঠানে সরকারের কোনো নজর নেই। নেই সহায়তার হাত। পৃষ্ঠপোষকতার তো দূরের কথা, পার্বত্য অঞ্চলের এতবড় পারদর্শী, গুণী ও ত্যাগী চারুশিল্পী প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যার মূল্যায়ন, সম্মাননা ও স্বীকৃতি পর্যন্ত দিতে পারেনি সরকার। এর চেয়ে দুঃখের আর কী থাকে ?
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.