সংরক্ষিত বন ভূমি ঘোষনা করায় রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া ইউনিয়নে দুই মৌজায় বসবাসরত ৪০ হাজারের অধিক মানুষ উচ্ছেদের আতংকের মধ্যে দিয়ে বসবাস করছেন। বন ভিাগের এহেন সংরক্ষিত বন ঘোষনায় এলাকার মানুষের তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
এলাকাবাসী ও একাধিক সূত্রে জানা গেছে, পানি থেকে বিদ্যূৎ উৎপাদনের লক্ষে ১৯৬০ সালের দিকে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের কর্ণফূলী নদীর উপর বাঁধ দিয়ে তৈরী করা হয় কর্ণফুলী জল বিদ্যূৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এ বাঁধের ফলে এক লাখের মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। এর মধ্যে কিছু অংশ মানুষ কাউখালী উপজেলার বিভিন্ন স্থানসহ বেতবুনিয়া ইউনিয়নের স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। এছাড়া ১৯৮১-৮২ সালে সমতল ভূমি থেকে অনেক পুর্নবাসিত পরিবার বাসবাস শুরু করে। কিন্তু বন আইন ১৯২৭ সালের ১৬ নং আইনের চার ধারা অনুযায়ী ১৯৯২ সালের ৪ জানুয়ারী বেতবুনিয়াকে সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা করে। পরবর্তীতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রনালয় ১৯৯৯ সালের ১মার্চ ৬হাজার ৩২৯ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চলকে প্রজ্ঞাপণ জারি করে গেজেট আকারে প্রকাশ করে। এর ফলে দুই মৌজাবাসীর অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয়। তবে ওই সময়ে এলাকাবাসী সংরক্ষিত বন ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, জনসভা, মিছিল, মিটিংসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এসব দাবী বনভূমি গঠনে ঘোষণা বাতিলের জন্য আবেদন জানিয়ে স্মারকলিপি দেয়। বন আইনের ৬নং ধারায় ফরেষ্ট সেটেলম্যান অফিসার নিয়োগের মাধ্যমে প্রস্তাবিত সংরক্ষিত বনভূমি এলাকার জনগনের কোন অস্তিত্ব, আপত্তি বা দাবি দাওয়া নিষ্পত্তি করার বিধান থাকলেও কোন আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়নি। যা বন আইনের ৬নং ধারা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হওয়ায় এলাকাবাসী আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেতবুনিয়া ইউনিয়নের বেতবুনিয়া ও কাশঁখালী মৌজায় দশ হাজার ৯২০ একর জায়গা রয়েছে। এ দুই মৌজায় ৪০ হাজারের অধিক পাহাড়ী-বাঙালী সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। বেতবুনিয়া ইউনিয়নে জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজরিত বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র রয়েছে। যা বর্তমানে সজীব ওয়াজেদ জয় উপগ্রহ ভূ- কেন্দ্র নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং সেন্টার (পিএসটিএস),সেহেরী বাজার, শতাধিক স্কুল, মাদ্রাসা ও ৭২ টি মসজিদ-মন্দির রয়েছে। তবে এ ইউনিয়নে বন বিভাগের অঞ্চলে বন বিভাগের আওতায় বনের কোন অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়নি। এছাড়া স্থানীয়রা বংশ পরমপরায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারনে রেকর্ডিয় ভূমির পাশাপাশি খাস পতিত জমিতে বসতবাড়ী নিমার্ণ করে তাদের দখলীয় জায়গায় ফলজ ও বনজ বাগান করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
বেতবুনিয়া ইউপির সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার লাসিউ মারমা, ওয়ার্ড মেম্বার সুইচহ্লা মারমা রকি, সুইবায়ং মারমাসহ অন্যান্যরা বলেন, এ এলাকায় কোন বন ভূমি ছিল না। এ এলাকায় ব্রিট্রিশ শসনামল থেকে পদ্ধতিগতভাবে তারা জুম চাষসহ নানান চাষাবাদ করে আসছেন। সংরক্ষিত বন এলাকা ঘোষনা পর পর থেকে এলাকাবাসী আতংকে বসবাস করছেন। এ এলাকার মানুষ যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছেন। তাদের এলাকা ছেড়ে হলে কোথায় যাবেন। তারা অবিলম্বে ঘোষিত প্রজ্ঞাপণ বাতিলের দাবী জানান।
বেতবুনিয়া ইউপি চেয়ারম্যান অংক্যজ চৌধুরী বলেন, সংরক্ষিত বন হিসেবে প্রজ্ঞাপণ ঘোষনার পর থেকে এ ইউনিয়নের মানুষ আতংকে ও অশান্তিতে রয়েছেন। এ ইউনিয়নে বন বিভাগের কোন অস্তিত্ব নেই। এখানে লোকজনের সম্পুর্ণ দখলীয় জায়গা। বন বিভাগ গোপণীয়ভাবে প্রজ্ঞাপণ জারি করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এখানরকার মানুষদের উদ্ধাস্তু করতে নীলনক্সা করছে।
কাউখালী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শামশু দোহা চৌধুরী বলেন, ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেতবুনিয়া ও কাঁশখালী মৌজাকে সংরক্ষিতা বনাঞ্চল ঘোষনা করেছে। তখন এর প্রতিবাদে আন্দোলন,জনসভা ও স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল। এসব কারণে আমরা মনে করেছি আন্দোলন ফলপ্রসু হয়েছে। কিন্তু এ ইউনিয়নে গৃহহীনদের জন্য প্রধামন্ত্রীর উপহারের আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর করতে গেলে বন বিভাগের প্রজ্ঞাপণের কারণে হয়নি। তিনি কারো না কারোর ইঙ্গিতে এ প্রজ্ঞাপণ করা হয়েছে উল্লেখ করে সরেজমিনে তদন্ত করে বাস্তবতার নিরিখের প্রজ্ঞাপণটি বাতিল করে স্বাধীনভাবে বসবাসের দাবী জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. মোঃ জাহিদুর রহমান মিয়া বলেন,১৯২৭ সালের বন আইনের ধারা অনুযায়ী ভূমি অধিগ্রহন করতে হলে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ,সময়, আপত্তি ও আপত্তি না থাকলে চুড়ান্ত অধিগ্রহন ঘোষনা করা হয়। তবে বেতবুনিয়াতে ১৯৯২ সালে বন ভূমি করার সিদ্ধান্তের নোটিশ জারি করার পর ১৯৯৯ সালে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে। তার আগে সময় দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া সে সময় জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব)কে ফরেষ্ট স্যাটেলমেন্ট অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি তদন্ত ও জনগণের সাথে মতামত নিয়ে রিপোর্ট দিয়েছেন। সে সময় ভূমি নিয়ে কেউই আপত্তি জানায়নি। তিনি বলেন, বন আইন অনুযায়ী রিজার্ভ ফরেষ্টকে ডি-রিজার্ভ ঘোষনার ক্ষমতা একমাত্র সরকার প্রধানের রয়েছে, বন বিভাগের নেই। এছাড়া এসডিজি গোলেও জীব বৈচিত্রৗ রক্ষা ও সংরক্ষনের রিপোর্ট করাসহ বাংলাদেশের দায়বদ্ধতা রয়েছে।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও বেতবুনিয়া মৌজার হেডম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী বলেন, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষনার আগে তৎকালীন নিয়োগ দেওয়া ফরেষ্ট স্যাটেলমেন্ট অফিসার(অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক,রাজস্ব) তিনি দুএকদিন গণ শুনানীর মতো করেছেন। তার কাছে দাবীসহ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, বনমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ ও সভা সমাবেশ করেছি। তখন আশ^স্ত করা হয়েছে বাস্তবতার কারণে বন ভূমি করা হবে না। কিন্তু জনগনের আন্দোলনের মুখে তা প্রকাশ না করে গোপণে সংরক্ষিত বন ভূমি ঘোষনা করে কাগজে কলমে রাখা হয়েছে। এছাড়া ৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তিতে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে পরিষদের মতামত নিতে হয় কিন্তু তা করা হয়নি। সম্পুর্ণ উপেক্ষা করে ও জনগনের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে ঘোষনা করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, বেতবুনিয়া ও কাঁশখালী মৌজায় দশ হাজার একর ভূমি রয়েছে। এ দুই মৌজায় ৫ হাজার একর জমি বন্দাবস্তি রয়েছে আর বাকী অংশ খাস জমিতে মানুষের দখলে রয়েছে। এখানে বন বিভাগের কোন অস্তিত্ব নেই। ফলে যেখানে এক ইঞ্চিও জায়গা খালি নেই সেখানে কোথায় সংরক্ষিত বন ভূমি করবে? তাই হাজার হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করে বন ভূমি করা একটি জটিল প্রক্রিয়া। তিনি জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে প্রজ্ঞাপণটি বাতিলের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানান।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.