শুক্রবার রাজধানী ঢাকায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও কাপেং ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে লংগদুতে পাহাড়ী গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলা, অগ্নিসংযোগ এর প্রতিবাদে ও ক্ষতিগ্রস্থদের দ্রুত পুর্নবাসনের দাবীতে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদ সন্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত জুম্মদের দাবিনামা অনুসারে অচিরেই প্যাকেজ পরিকল্পনা ঘোষণা পূর্বক ক্ষতিগ্রস্ত জুম্মদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন, জুম্মদের ঘরবাড়ি অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে জড়িত সকল ব্যক্তিদের অচিরেই গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি,ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের বই পুস্তক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা সামগ্রী প্রদান করে জরুরী ভিক্তিতে তাদের শিক্ষা জীবন সুনিশ্চিত ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ, দ্রুত ও যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য অবিলম্বে সময়সূচি ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ ঘোষণা করার দাবী জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও কাপেং ফাউন্ডেশনের মুখপাত্র হিরন মিত্র চাকমার স্বাক্ষরিত এক প্রেস বার্তায় বলা হয়,ঢাকার সেগুন বাগিচার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির গোল টেবিল মিলনায়তনে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এর সভাপতিতে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সন্তোষিত চাকমা বকুল, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ সাধারণ সম্পাদক ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতো প্রমুখসহ আদিবাসী নেতৃবৃন্দ। সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পদক দীপায়ন খীসা। সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা।
সংবাদ সন্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বলেন, ২০০৪ সালে মহালছড়ির ১৪টি গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগের পর সরকার কথা দিয়েছিল এই ধরনের মানবতা বিরোধী ঘটনা আর ঘটতে দেবে না। অথচ এই ধরনের ঘটনা এখন ও পর্যন্ত প্রতিনিয়ত ঘটানো হচ্ছে। লংগদুতে যে ঘটনা ঘটেছে তা নিন্দনীয় ও মানবতা বিরোধী। তিনি অবিলম্বে লংগদু ঘটনায় দোষীদের বিচার করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত পুনর্বাসন করতে হবে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন,এদেশে পাহাড়ী আদিবাসী ও জাতিগত সংখ্যালঘুর উপর ভয়াবহ মানবাধিকার লংঘন চলছে। নতুন নতুন সংকট ও মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে। জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়ের উর্দ্ধে এ রাষ্ট্রে সকল মানুষের অধিকার সমান হবে। রাষ্ট্রে গারো, চাকমা, মারমা বা সাঁওতাল হবার কারনে কাউকে বৈষমের শিকার হতে হবে না। বাস্তবে রাষ্ট্র হয়ে গেছে কঠিন ও নির্দয়। সকল নাগরিকের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র আদিবাসীদের থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন,বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের উপর নিপীড়ণ চালানো হচ্ছে। রাষ্ট্র পাহাড়ীদেরকে পর মনে করেন বিধায় তাদের ঘরে আগুন লাগানো সত্বেও স্বাধীন দেশে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই রাষ্ট্র বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল মানুষের তাই পাহাড়ীদেরকেও আপন করতে হবে। ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৯৮ শতাংশ পাহাড়ী এবং ২ শতাংশ বাঙালির জনবসতি ছিল। বর্তমানে সেখানে বসবাসকারি পাহাড়ী ও বাঙালিদের সংখ্যানুপাত যথাক্রমে ৫৪:৪৬। এই সংখ্যানুপাতের সহজ বিচার-আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী অধিবাসী ডেমোগ্রাফিক রাজনীতির শিকার।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সন্তোষিত চাকমা বকুল বলেন-গত ২ জুন পার্বত্য চট্টগ্রামের লংগদু’তে আদিবাসীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। পার্বত্য চট্টগ্রামে আজ পর্যন্ত এই ধরনের কোন ঘটনার বিচার হয়নি।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পদক দীপায়ন খীসা বলেন,লংগদু হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ীরা দীর্ঘ এক মাস পরেও নিজ বাস্তভিটায় ফিরতে পারেনি। এই বর্ষাকালে তারা মানবেতন দিন যাপন করছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জীবন আজ অনিশ্চিত। সরকারের ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ীরাদের পুনর্বাসনের কোন পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা তার মূল বক্তব্যে বলেন, গেল ২ জুন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকাল ২টা পর্যন্ত রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলা সদরের তিনটিলা এবং পার্শ্ববর্তী মানিকজোড়ছড়া ও বাত্যা পাড়ায় সেটেলার বাঙালিরা জুম্মদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটসহ সংঘবদ্ধ সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়।
এ হামলায় তিনটিলায় জুম্মদের ৯টি দোকানসহ কমপক্ষে ১২২টি ঘরবাড়ি; মানিকজোড়ছড়ায় ৬টি দোকানসহ ৮৬টি ঘরবাড়ি এবং বাত্যা পাড়ায় ৪টি দোকানসহ অন্তত ২৮টি ঘরবাড়ি- সর্বমোট ২৩৬টি বাড়ি ও দোকান সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয় এবং ৮৭টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনটিলা এলাকায় গুণমালা চাকমা নামে ৭৫ বছরের এক অশীতিপর বৃদ্ধা পালিয়ে যেতে না পারার কারণে ঘরের মধ্যে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় এবং হামলাকারীদের মারধরের শিকার হন অনেক জুম্ম গ্রামবাসী। প্রায় তিন শতাধিক পরিবার কেউই কোন সহায় সম্পত্তি রক্ষা করতে পারেনি এবং এক কাপড়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে কোন রকমে জীবন রক্ষা করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ীদের তালিকা অনুযায়ী যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩৩ কোটি ৫৫ লক্ষ টাকা।
তিনি আরো বলেন,মোটর সাইকেল চালক নুরুল ইসলাম নয়নকে যে বা যারা অপহরণ ও অপহরণের পর হত্যা করুক না কেন তা নি:সন্দেহে নিন্দনীয় এবং হত্যার সাথে যে বা যারা জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা উচিত। কিন্তু সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢালাওভাবে নিরীহ পাহাড়িদের শত শত ঘরবাড়ি অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
তিনি দাবী করে বলেন, লংগদুতে পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনার এক মাস অতিক্রান্ত হলেও এখনো ক্ষতিগ্রস্ত জুম্ম গ্রামবাসীরা স্ব স্ব বাস্তুভিটায় ফিরতে পারেননি। তারা এখনো মানিকজোড়ছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বামে লংগদু নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও তিনটিলা বৌদ্ধ বিহার- এই তিনটি আশ্রয় কেন্দ্র এবং আত্মীয়-স্বজনের ঘরবাড়িতে গাদাগাদি করে এই বর্ষাকালে মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন এবং স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীদের বই পুস্তক, স্কুল ড্রেস ও অন্যান্য শিক্ষা সামগ্রী পুড়ে যাওয়ায় বর্তমানে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়ি নির্মাণ বাবদ যথোপযুক্ত অর্থ ও কমপক্ষে তিন বছরের রেশনসহ পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও যথাযথ পুনর্বাসন এবং তাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জুম্মদের ঘরবাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের সাথে জড়িতদের অচিরেই গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের দাবি জানান।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.