মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকায় সাবেক সাংসদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার(এমএন লারমা) ৩৭ তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়েছে।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের স্বাক্ষরিত এক প্রেস বার্তায় বলা হয়, ধানমন্ডির উইমেন ভলান্টারী এসোসিয়েশনে স্মরণ সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সাংবাদিক ও কলামিষ্ট আবু সাঈদ খান। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি, ঐক্যন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচায্য, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন ড. সাদেকা হালিম,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদদ(ঢাকসু) সাবেক সাধারণ সম্পাদক(১৯৮৯-৯০)ডা. মুশতাক হোসেন, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স, নুমান আহম্মদ খান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সহ সভাপতি নজরুল কবীর, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার প্রমুখ।
শোক প্রস্তাব পাঠ করেন জাতীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী। স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জাতীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ড. জোবাইদা নাসরীন কণা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটির যুগ্ন আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস।
স্মরণ সভায় শ্রদ্ধাঞ্জলি, গণসংগীত, প্রদীপ প্রজ্বলন ও স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। এছাড়া এমএন লারমার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন ও পুষ্পস্তবক প্রদান করা হয়। এরপর আদিবাসী গানের দল মাদল সূচনা সংগীত পরিবেশন করা হয়।
বিকালে গণসংগীত পরিবেশিত হয় ও সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্জলন করা হয়। প্রতিবাদী গান পরিবেশন করেন সমগীত, এফ মাইনর ও মাদল। কবিতা পাঠ করেন রূপশ্রী চক্রবর্তী। স্মরণ সভায় অংশ নেয় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, ঐক্য ন্যাপ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি, মহিলা পরিষদ, বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, কাপেং ফাউন্ডেশন, এএলআরডি, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, জনউদ্যোগ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, বাগাছাস, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, গানের দল মাদল, আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
স্বাগত বক্তব্যে জোবাইদা নাসরীন কনা বলেন, যে সময়ে আমরা আজকে স্মরণসভা করছি সেসময়ে বান্দরবনে ভুমি অধিকারের জন্য আন্দোলন চলছে। যে মানুষটি এখনো আমাদেরকে স্বপ্ন দেখান তিনি মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা। কেন মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাকে স্মরণ করবো। তাঁর আদর্শের জন্য তাঁকে স্মরণ করা দরকার। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন অনলাইনে যুক্ত হয়ে বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা গণতান্দ্রিক, প্রগতিশীল বাংলাদেশের জন্য স্বপ্ন দেখেছেন। এজন্য তিনি বাংলাদেশের সংবিধানকে সেভাবেই পেতে চেয়েছিলেন। তিনি এজন্য সংসদে তুমুল বিতর্ক করেছেন। সংবিধানে জাতি হিসেবে বাঙালী পরিচয় নির্ধারণ করা হলো। তিনি প্রতিবাদ করেছেন। পঞ্চদশ সংশোধনীতে সেই ভুল সংশোধনের সুযোগ হয়েছিল। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি আনতে হবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, উপজাতি পরিচয় বা নাম একটি জাতির জন্য পরিচয় হতে পারে না। আদিবাসীদের যে রাজনৈতিক সমস্যা সেটা সমাধান হওয়া দরকার। তাদের ন্যায্য অধিকার দেওয়া উচিত।
ঐক্যন্যাপের সভাপতি শ্রী পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, এমএন লারমা জুম্মদের অস্তিত্ব ধ্বংসের বিরুদ্ধে সচেতন ও লড়াই করেছেন। তিনি আজীবন ন্যায্য অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন। তিনি আপাদমস্তক সংগ্রামী ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মানবতাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে। অসাম্প্রদায়িক সমাজের আকাঙ্খা এখনো রয়ে গেছে। সেই সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এমএন লারমার আদর্শ আমাদের পাথেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, আদিবাসী ও মেহনতি মানুষের জন্য তাঁর যে অবদান সেটার স্বীকৃতি দেওয়া দরকার। ক্ষণজন্মা এই নেতা যদি আরো বেঁচে থাকতেন আরো অবদান রাখতে পারতেন। তিনি সবসময় নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের কথা বলেছেন। তিনি শুধু নিজ জাতির কথা বলেননি, তিনি গণমানুষের কথা বলেছেন।
তিনি আরো বলেন, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যে দলের সাথে এই চুক্তি হয়েছে সেই দল তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি শিক্ষার জন্যও কাজ করেছেন। তিনি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য গভীর অনুশীলন করেছেন। তিনি বিভেদে জড়াতেন না। তিনি ক্ষমা করো, ভুলে যাও নীতি প্রয়োগ করে ঐক্যের জন্য কাজ করতেন। ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে পারলে এমএন লারমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ২৬ বছরের রাজনৈতিক জীবন তথা তাঁর ৪৪ বছরের জীবনে এমএন লারমা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। যুব সমাজকে তাঁর আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তিনি সংসদে সরব ছিলেন। তিনি সংবিধানে বাঙালী পরিচয়ের তীব্র বিরোধীতা করেছিলেন। তিনি আরো বলেন, একজন বাঙালী যেমন ইংরেজ হতে পারে না ঠিক তেমনি এদেশের জুম্ম জনগনও বাঙালী হতে পারে না। সংবিধানে যে অপূর্ণতা সেটার জন্যও সংগ্রাম করতে হবে। আদিবাসীদের অধিকারের জন্য আমাদের লড়াই জারি রাখতে হবে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা অনলাইনে আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, এমএন লারমা ছিলেন দূরদর্শী এক রাজনীতিবিদ। তিনি একজন জাতীয় নেতা। তাঁর নামে রাঙামাটিতে কলেজ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে পারে, করা উচিত। এই দিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। এমএন লারমা শুধু জুম্মদের নিয়ে স্বপ্ন দেখেননি, তিনি আপামর বাংলাদেশের জন্য স্বপ্ন দেখেছিলেন। মেহনতি মানুষ, নারী-পুরুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যারা বৈষম্যের শিকার তাদের কথা তিনি সংসদে উত্থাপন করেছিলেন। এজন্য তিনি সকলের নেতা।
সাবেক সাংসদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিরসহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার বলেন, এমএন লারমা জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত। তিনি শিক্ষার জন্যও লড়াই করেছেন। তাঁর বাবা ও জ্যাঠা পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা বিস্তার করেছেন। তিনি শুধু আদিবাসীদের জন্য নয় তিনি বাংলার মেহনতি মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছেন যার উদাহরণ আমরা সংসদীয় বক্তব্যে খুঁজে পায়। তিনি প্রগতিশীল আদর্শের জন্য মৃত্যুবরণ করেছেন। যদিওবা তিনি সহকর্মীদের দ্বারা নিহত হয়েছেন তারা ছিলেন একটি স্বার্থান্বেসী মহলের পুতুল। সেই গোষ্ঠী এমএন লারমাকে হত্যা করে আন্দোলনকে ধ্বংস করতে চেয়েছে।
তিনি আরো বলেন, কাপ্তাই বাঁধ করে জুম্মদের মেরুদন্ড শেষ করতে চেয়েছে। আজ চুক্তি করেও চুক্তি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন কর্মীদের দমন করা হচ্ছে। পার্বত্য বাসী এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায়। ভূমি বেদখল করা হচ্ছে। সম্প্রতি বান্দরবনে ম্রোদের জায়গা-জমি বেদখল করে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ করা হচ্ছে। পাহাড়ে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হওয়া দরকার। সেই উদ্দেশ্যে সরকার ১৯৯৭ সালে চুক্তি করেছে। এই চুক্তি যথাযথভাবে দ্রুত বাস্তবায়ন হওয়া দরকার। এমএন লারমাও পার্বত্য সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছেন। ন্যায্য অধিকার পেতে চেয়েছিলেন।
মোশতাক আহমেদ অনলাইনে অংশ নিয়ে বলেন, মানুষের রাজনৈতিক অধিকারের জন্য এমএন লারমা অংশ নিয়েছেন। তিনি সাম্প্রদায়িতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।
ডা. অসিত বরণ রায় বলেন, প্রধানমন্ত্রী চুক্তি করেছেন যদিও চুক্তির অনেক বিষয় এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়ে গেছে। এই চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়া দরকার। এমএন লারমা সেই ন্যায্য অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন। জীবন উৎসর্গ করেছেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজ করে যেতে হবে। বঞ্চিত মানুষদের পাশে কীভাবে দাঁড়াতে হয় তাঁর একমাত্র শিক্ষা তিনি দিয়েছেন।
আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, এমএন লারমার জীবন মহামূল্যবান ছিল। তিনি বেঁচে থাকলে অনেককিছু পেতে পারতাম। আদিবাসী মানুষসহ বাংলাদেশও উপকৃত হত। তিনি পাহাড়ের মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি মেহনতি মানুষের অধিকারের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমরা জানি, সেই অধিকারের জন্য ১৯৯৭ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি করে যেন পাহাড়ের মানুষকে ঢোঁকা দেওয়া না হয় সেই বিনীত অনুরোধটুকু রাখতে চাই।
অনুষ্ঠানের সভাপতি আবু সাঈদ খান বলেন, এমএন লারমাই প্রথম বলেছিলেন আমার পরিচয় বাঙালী হতে পারে না, আমরা বাংলাদেশী। আমাদের উপলব্দিতে আসা দরকার যে, জোর করে কারোর পরিচয় নির্ধারণ করা যায় না। আমাদেরকে উদার হতে হবে। অহেতুক আতঙ্ক দূর করতে হবে। যার যার অধিকার তাকে দিতে হবে। প্রতিটি জাতিস্বত্তার স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। স্বীকৃতির প্রশ্নে তালবাহানা করা উচিত নয়। এমএন লারমা নিজ অধিকারের জন্য সচেতন ছিলেন। তিনি নিজ জাতির ঊর্ধ্বে গিয়ে গোটা বাংলাদেশের সমৃদ্ধির জন্যও চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন। তিনি উদার, প্রগতিশীল, অ-সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমি মনে করি, তিনি একজন জাতীয় নেতা। তাঁর নামে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে। এবং সেই চেষ্টা করা উচিত।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.