আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দিবসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের দাবী জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা)।
তিনি বলেন, আদিবাসীদের বঞ্চনার মাত্রা শিক্ষা থেকে শুরু করে ভূমি অধিকার, এমনকি বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৫ বছরে দেশের ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগণ মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। সম্পূর্ণ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আদিবাসী ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ক্রমাগতভাবে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
তিনি অভিযোগ করে আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণরূপে একপাশে ও অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখা হয়েছে। সরকার একের পর এক চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম-স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে।
শনিবার আগামী ৯ আগষ্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসকে সামনে রেখে ঢাকার হোটেল সুন্দরবনে আয়োজিত সংবাদ সন্মেলনে সন্তু এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের উদ্যোগে আয়োজি সংবাদ সন্মেলনে এসময় অন্যান্যর মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, ঐক্য ন্যাপের আহ্বায়ক ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ পংকজ ভট্টাচার্য, বিশিষ্ট গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, আদিবাসী নেতা রবীন্দ্রনাথ সরেন, শক্তিপদ ত্রিপুরা প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।
সংবাদ সন্মেলনে সন্তু লারমা লিখিত বক্তব্যে বলেন, যুগ যুগ ধরে ঐতিহাসিক শোষণ ও বঞ্চনার কারণে আদিবাসীরা প্রান্তিক অবস্থায় চলে গেছে। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার থেকে বহু কাল আদিবাসীরা বঞ্চিত রয়েছে। ফলে সাধারণ শিক্ষা ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে আদিবাসী সমাজ পিছিয়ে রয়েছে।
জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০ আদিবাসীদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতীয় শিক্ষা নীতির “আদিবাসী শিশু” অনুচ্ছেদে আদিবাসী শিশুরা যাতে নিজেদের ভাষায় শিখতে পারে সেই লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্য পুস্তকের ব্যবস্থা করা হবে। এই কাজে, বিশেষ করে পাঠ্য পুস্তক প্রণয়নে, আদিবাসী সমাজকে স¤পৃক্ত করা হবে। আদিবাসী প্রান্তিক শিশুদের জন্য বিশেষ সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে। তিনি আদিবাসীদের শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষা নীতির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং আদিবাসী অঞ্চলের স্কুলগুলোতে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানান।
দেশে আদিবাসী ভূমি দখলের উৎসব চলছে অভিযোগ করে তিনি বলেন,আদিবাসীদের কাছে ভূমিই জীবন ও অস্তিত্বের প্রতীক। ভূমি ছাড়া আদিবাসীদের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। ভূমি মানেই জীবন। বিশ্বজুড়ে ভূমি আদিবাসীদের কাছে পবিত্র। এখনো প্রতিনিয়ত জমি হারাচ্ছেন আদিবাসীরা। শুধু ভূমিলোভী চক্র নয়, কখনও কখনও সরকার বিভিন্ন প্রকল্প বিশেষত ন্যাশনাল পার্ক, ইকো-পার্ক, রিজার্ভ ফরেস্ট, সামাজিক বনায়ন, সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প ও স্থাপনা সম্প্রসারণ ইত্যাদির কারণে আদিবাসীরা ভূমি হারাচ্ছেন। ইকো-পার্কের নামে খাসিয়া ও গারোদের উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়েছিল।
সন্তু লারমা আরো বলেন,পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৮ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম (উপজাতীয়) অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন বিষয় ও কার্যাবলী কার্যকরকরণ এবং এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিতকরণ; পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিকরণ; আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তু ও প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ ও পুনর্বাসন; সেনা শাসন ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার; অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ভূমি ইজারা বাতিলকরণ; পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকুরীতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী অধিবাসীদের নিয়োগ; চুক্তির সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইনসমূহ সংশোধন; সেটেলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন ইত্যাদি বিষয়গুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান এখনো কাক্সিক্ষত পর্যায়ে অগ্রগতি লাভ করেনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও আইন মোতাবেক জুম্ম জনগণের ভূমি অধিকার নিশ্চিত না করে বিজিবি ক্যাম্প স্থাপনের নামে, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের নামে, রিজার্ভ ফরেষ্ট ঘোষণার নামে, ব্যবসায়ী এবং প্রভাবশালী আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিকে হর্টিকালচার ও রাবার চাষের নামে ইজারা প্রদান করে হাজার হাজার একর জুম্মদের সামাজিক মালিকানাধীন জুমভূমি ও মৌজাভূমি জবরদখল করা হচ্ছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন,সরকার চুক্তি অনুযায়ী ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না করে উত্তরোত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যাকে জটিল করে তুলছে। পার্বত্যবাসীর চরম বিরোধিতা সত্ত্বেও জনমতকে পদদলিত করে উন্নয়নের নামে আইন-শৃংখলা বাহিনীর প্রহরায় রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে। এভাবে সরকার চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে জুম্মদের জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের কাজ জোরালোভাবে বাস্তবায়ন করে চলেছে।
সংবিধানে এখনো আদিবাসী জাতিসমূহের জাতিসত্তা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভূমি অধিকারসহ মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আদিবাসী সংগঠনের পক্ষ থেকে বার বার বলার চেষ্টা করা হয়েছে আদিবাসী জনগণের আত্ম-পরিচয়ের অধিকার রয়েছে। এটি আদিবাসীদের মানবাধিকার। আন্তর্জাতিকভাবেও আদিবাসীদের আত্ম-পরিচয়ের অধিকার স্বীকৃত। তিনি সংবিধান সংশোধন করে আদিবাসী জাতিসমূহের আশা-আকাক্সক্ষা ও দাবির ভিত্তিতে আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভূমি অধিকারসহ মৌলিক অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের জোর দাবি জানান।
তিনি আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো নয় উল্লেখ করে বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল ও তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার হীন উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদ, আদিবাসী নারীর উপর ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণসহ নৃশংস সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। ২০১৫ সালে সারাদেশে ৮৫ জন আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশু শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। চলতি বছরে জুন পর্যন্ত ২৯ জন আদিবাসী ও শিশু যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে।
প্রবীন রাজনীতিবিদ পংকজ ভট্টাচার্য তার সংহতি বক্তব্যে বলেন, সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম যুক্ত করে আদিবাসীদের আত্মপরিচয়কে অস্বীকার করা হয়েছে যা পক্ষান্তরে এদশে জঙ্গীবাদকে উৎসাহিত করেছে। এছাড়া উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের ভূমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
বিশিষ্ট গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, আজকের এই দাবী সারাদেশের ত্রিশ লক্ষাধিক আদিবাসী ও ৫০টিরও অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বেদনার বহিপ্রকাশ। চুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন এত বছর পরেও রাষ্ট্র কেন তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না তার একটা বিবৃতি দেওয়া প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, সমতলের আদিবাসীদের বিদ্যমান ভূমি সমস্যা সমাধান করা ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অদিবাসী দিবস পালন করা প্রয়োজন।
সংবাদ সন্মেলনে আদিবাসীদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতকরণে বিশেষ পদক্ষেপ,আদিবাসীদের শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ বাজেট বরাদ্দ, আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত ভূমি অধিকার কার্যকর, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সময়সূচি-ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ ঘোষণা, ভূমি কমিশন আইন অবিলম্বে কার্যকর করা, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০০৭ সালে গৃহীত আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র অনুসমর্থন ও বাস্তবায়ন,আইএলও কনভেনশন ১০৭ বাস্তবায়ন ও ১৬৯ নং কনভেনশন অনুস্বাক্ষর করা,সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য অবিলম্বে ভূমি কমিশন গঠন করা, জাতিসংঘ ঘোষিত ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করাসহ ১০ দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.