পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ীত্বশীল শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং পার্বত্যবাসীর আত্ননিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের ধারা গড়ে না উঠায় পূর্বের মত এখনো চাপিয়ে দেয়া উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। উন্নয়ন কর্মকান্ডে এ অঞ্চলের স্থায়ী অধিবাসীদের বিশেষ করে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নির্ধারনী ভূমিকা ও উন্নয়ন পুর্নাঙ্গ অংশগ্রহন নিশ্চিত হয়নি।
বুধবার রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০১৪-এর শীর্ষক দিন ব্যাপী কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ সন্মেলন কক্ষে সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড এন্ড ডেভেলাপমেন্ট(সিআইপিডি)-এর আয়োজিত কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন সিআইপিডির চেয়ারপার্সন ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফের মংসানু চৌধুরী। অতিথি হিসেবে বক্তব্যে দেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য নুরুল আলম, নারী নেত্রী টুকু তালুকদার ও রাঙামাটি প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন রুবেল। স্বাগত বক্তব্যে রাখেন সিআইপিডির নির্বাহী পরিচালক জনলাল চাকমা। কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ পাঠক করেন আদিবাসী নেতা মঙ্গল কুমার চাকমা। কর্মশালায় বিভিন্ন পেশা শ্রেনীর লোকজন অংশ নেন।
মূল প্রবন্ধে সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তির আইন অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সকল ক্ষমতা ও কার্যাবলী কার্যকরণ,পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের সহজ শর্তে ঋণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা এবং জুম চাষী ও ভুমিহীনদের জন্য উৎপাদনমুখী কার্যক্রম সরকারী সেবা নিশ্চিতপার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ীত্বশীল, গণমুখী ও পরিবেশ বান্ধব উন্নয়নের স্বার্থে পার্বত্য চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমুহ দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া, প্রত্যাগত পাহাড়ী শরনার্থী ও অভ্যন্তরীন পাহাড়ী উদ্বাস্তুদের পুর্নবাসন ও তাদের স্ব-স্ব জায়গা জমিতে প্রর্ত্যাপণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনারয় কর্তৃক চুড়ান্তকৃত ১৩ দফা সংশোধনী প্রস্তাব অনুসারে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন ২০০১ সংশোধন করে ভূমি কমিশনের মাধ্যমে অচিরেই পার্বত্য ভূমি বিরো নিষ্পত্তি করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প ও অপারেশন উত্তরণ প্রত্যাহার, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় অধ্যূষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট সংরক্ষনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য অধিকতর অর্থ বরাদ্দ, প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন গবেষনা, পরিবেশ বান্ধব চাষাবাদ, বানায়ন, আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশের ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে বলে সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রবন্ধে আরও উল্লেখ করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের নামে সরকারী অফিস, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মানে এবং যোগাযোগ তথা রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট নির্মানে শতকরা ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে যা প্রত্যক্ষাভাবে জনগনের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আবদান রাখতে পারছে না, এসব উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহনেকোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও স্বচ্ছতা নেই। ব্যক্তিগত ও দলীয় প্রভাবে প্রকল্প বাছাই করা হয়, প্রকল্প বাস্তবায়নের মনিটরিং, জবাব দিহিতা নেই ও মানসম্মত কাজ করা হয় না, স্বপ্ল মেয়াদী প্রকল্প গ্রহন করা হয় যা টেকসই উন্নয়নে আবদান রাখছে না, সংস্থার সমুহের সমন্বয় নেই,বিক্ষিপ্তভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন কৌশলে আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা উপেক্ষা করা হয়, ফলে জনগণের স্বতস্ফুর্ত অংশ গ্রহন নিশ্চিত হয় না।
কর্মশালায় নারী নেত্রী টুকু তালুকদার বলেন, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পূর্বে এ অঞ্চলে উন্নয়ন হয়নি। চুক্তির পরবর্তী সময়ে উন্নয়ন কাজ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এনজিও সংস্থাসমুহ এলাকায় উন্নয়নে বড় অবদান রাখছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এনজিও-এর মাধ্যমে এখানে বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এনজিও-এর মাধ্যমে এখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারী উন্নয়ন হচ্ছে। নারীদের উন্নয়ন হচ্ছে বলে বর্তমানে ৭৪থেকে ৭৬ জন নারীকে কারবারী পদে বসনো হয়েছে। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ কি কি উন্নয়ন হচ্ছে তার কোন স্বচ্ছ ও জবাব দিহিতা নেই। কি কি উন্নয়ন করা হচ্ছে তা জনসম্মুখে তুলে ধরা প্রয়োজন।
সাখাওয়াত হোসেন রুবেল বলেন, নিজেদের উন্নয়ন নিজেরাই করতে হবে। পার্বত্য জনগণ নির্ধারণ করবে উন্নয়নের নীতিমালা। পার্বত্য চট্টগ্রাম কিভাবে চলবে তা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ নির্ধারণ করবে।
নুরুল আলম বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় মানুষ হতাশ। চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে আঞ্চলিক পরিষদ কাজ করতে পারছে না। তিনি বলেন,রাঙামাটিতে গ্যাস অত্যন্ত প্রয়োজন। পাশের উপজেলা কাপ্তাইয়ে গ্যাসের সংযোগ রয়েছে। গ্যাস না থাকায় বড় বড় বিনিয়োগকারী পুজি বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছে না। তাছাড়া এখানে হিমাগার ও ফায়ার রিভার সার্ভিস নেই। এগুলো আত্যন্ত প্রয়োজন।
প্রফেসর মংসানু চৌধুরী পার্বত্য গতিধারাকে উন্নয়নে অনুভব করতে আজকের এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে এনজিওদের উন্নয়নের সমন্বয়কারী কর্তৃপক্ষ কে? পার্বত্য জেলা পরিষদ না জেলা প্রসাশন। এখানে দ্বৈত কর্তৃপক্ষ রয়েছে। আর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, এখানে স্বাধীনভাবে কাজ করতে গেলে এক ধরনের বিড়ম্বনা তৈরী হয়। দারিদ্র থেকেই মুক্তি হল উন্নয়নের মূল লক্ষ্য। এখানে টপ ডাউন এপ্রোস যতদিন হবে না ততদিন এখানে উন্নয়নের প্রতিফলন ঘটবে না।
তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চুক্তির আলোকে পার্বত্য মন্ত্রনালয়, আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ করা হয়েছে। এগুলোর অবকাঠামো হয়েছে কিন্তু তাদের করনীয় ঠিক করা হয়নি। জেলা পরিষদের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ সন্তোষজনক। কিন্তু এসব বরাদ্দ শুধুমাত্র অবকাঠামোতে উন্নয়ন হচ্ছে। শিক্ষার মান উন্নয়ন হচ্ছে না। তাই অবকাঠামো ছাড়াও অন্যান্য পদ্ধতি উন্নয়ন করা না হয় তাহলে এখানে শিক্ষার মান উন্নয়ন হবে না। পাশাপাশি শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য ছেলে-মেয়েদের আগ্রহী করতে অন্যান্য সুযোগ সুবিধাগুলো বাড়াতে হবে।
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নসহ যে কোন কাজ করতে হলে আদিবাসী বিষয়ে নীতিমালা থাকা প্রয়োজন বলে গুরুত্বারোপ করেন।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.