হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে বান্দরবানে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের প্রতিবাদে এবং শেরপুরে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধের দাবিতে শুক্রবার ঢাকায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক এবং কাপেং ফাউন্ডেশন এই কর্মসূচির আয়োজন করে।
কাপেং ফাউন্ডেশনের সোহেল হাজং এর স্বাক্ষরিত এক প্রেস বার্তায় বলা হয়, ঢাকার শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা। বক্তব্যে দেন এএলআরডি-এর পক্ষ থেকে রিট দায়ের করা আইনজীবী অ্যাড. রফিক আহমেদ সিরাজী, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মানবেন্দ্র দেব, জনউদ্যোগের কেন্দ্রীয় সদস্য মাহবুল হক। এছাড়া সংহতি বক্তব্য প্রদান করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা, আদিবাসী যুব পরিষদের সভাপতি হরেন্দ্রনাথ সিং-সহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি, আশীষ হাজং, লিয়াং রিছিল, চন্দন কোচ, বেবিলন চাকমা, কাজল হাউই, বাদল হাজং, কাঞ্চন ¤্রং, সতীর্থ প্রমুখ। মানববন্ধনের শুরুতে আদিবাসী ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি খাস্রী রুখো মানববন্ধনের মূল বক্তব্য পাঠ করে শোনান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলিক মৃ।
মানববন্ধনে বলা হয়, গেল ২৪ ফেব্রুয়ারি মহামান্য হাইকোর্ট বান্দরবানের সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদী ও পার্শ্ববর্তী সংরক্ষিত ঝরনা, ঝিরি ও ছড়া থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধে একটি নির্দেশনা দেয়া সত্ত্বেও তা অমান্য করে পার্বত্য বান্দরবান জেলার লামা, আলীকদম, থানচি ও রোয়াংছড়ি-সহ প্রায় ৭টি উপজেলার সাঙ্গু, মাতামুহুরী নদী ও নদীর পার্শ্ববর্তী ঝর্ণা, ছড়া, খাল, ঝিরি থেকে নির্বিচারে ক্ষমতাসীন প্রভাবশালী ও অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করে চলেছে। এসব অঞ্চলে পাথর উত্তোলনের ফলে প্রায় ৪০০ঝিরি ও ঝর্ণা নষ্ট হয়ে গেছে। সেখানকার নদীগুলোও আজ পানিশূন্য। এইসব ঝিরি ও ঝর্ণাই হলো স্থানীয় আদিবাসীদের খাবার পানির একমাত্র উৎস। কিন্তু অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনে এই ঝিরি বা ঝর্ণাগুলো শুকিয়ে যাওয়ার ফলে বান্দরবানের স্থানীয় আদিবাসীদের জীবন ব্যবস্থা, পরিবেশ ভারসাম্য ও জীব-বৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখিন হয়ে পড়েছে। পানির অভাবে স্থানীয় আদিবাসীদের বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
মানবন্ধনে বক্তারা অবিলম্বে যেন বান্দরবান পার্বত্য এলাকার নদী, ঝর্ণা, ছড়া, ঝিরি থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ করা হয় এবং সেইসাথে শেরপুর জেলার শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ির নদী ও ডোবা থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করার দাবি জানান।
মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কোন অভাব নেই। তবুও হাইকোর্টের রায় অমান্য করে সেখানে নির্বিচারে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে কিন্তু প্রশাসন কিছু করতে পারছে না। বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে দূরবর্তী ঝিরি থেকে আদিবাসীদের খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়, এখন সেই ঝিরি শুকিয়ে যাচ্ছে তাহলে তারা যাবে কোথায়?’ তিনি অচিরেই এ পাথর উত্তোলন বন্ধ করার জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানান।
এএলআরডি-এর পক্ষ থেকে রিট দায়ের করা আইনজীবী অ্যাড. রফিক আহমেদ সিরাজী বলেন, ‘সরেজমিনে গিয়ে দেখেছি কতটা ভয়াবহভাবে বান্দরবানের এসব ঝিরি ও ঝর্ণা থেকে পাথর উত্তোলন করে স্তুপ করে রাখা হয়েছে! আমরা এ অবৈধ পাথর উত্তোলন বন্ধে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছি এবং পাথর উত্তোলন বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনাও পেয়েছি। কিন্তু এই উচ্চ আদালতের নির্দেশনাতেও যদি সেখানে পাথর উত্তোলন বন্ধ না করা যায়, তাহলে এর পরবর্তী ব্যবস্থা যা নিতে হয় আমরা সেদিকেই যাব।’
জনউদ্যোগের কেন্দ্রীয় সদস্য মাহবুল হক বলেন, বান্দরবানে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও শেরপুরে বালু উত্তোলন করে দেশের সংবিধান ও মানবাধিকার লঙ্ঘণ করা হয়েছে। পাহাড় ও পরিবেশ আদিবাসীদের জীবন। এ জীবনের ওপর হামলা করা হচ্ছে। এখনই প্রশাসনকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিরন মিত্র চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করা হয়েছে কিন্তু চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন নেই। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হলো কিন্তু তারও কার্যকারিতা নেই ঠিক তেমনিভাবে বান্দরবানে অবৈধ পাথর উত্তোলন বন্ধে হাইকোর্টের রায় হয়েছে কিন্তু সে রায়ের বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তার মানে এদেশে অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইনী বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রশাসন তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছে না।’
মানবন্ধনে অবিলম্বে বান্দরবান পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন নদী, ঝর্ণা, ছড়া, ঝিরি থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ, বান্দরবানে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে মহামান্য হাইকোর্টের রায় যথাযথভাবে বাস্তবায়ন, প্রশাসনকে এ রায় বাস্তবায়নে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ, সমতলের শেরপুরের শ্রীবর্দী ও অন্যান্য অঞ্চলের নদী ও ডোবা থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন কার্যক্রম বন্ধ করা, অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত সকল প্রভাবশালী ও ব্যবসায়ী চক্রকে আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তি প্রদান,আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর পরিবেশ এবং তাদের ভূমি-ভূখন্ড ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও রক্ষা করার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং দেশের বন, পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় রাষ্ট্র বা প্রশাসনকে আরো মনোযোগী ও তৎপর হওয়ার দাবী জানানো হয়েছে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.