প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন,পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ভূমি বিরোধ, সেই জটিলতাও শিগগির সমাধান হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সহযোগিতা করলে এই বিষয়টিরও মীমাংসা হতে পারে।
তিনি বলেন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ সংশোধন পূর্বক “ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০১৬” সংশোধিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে এবং বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন বিধিমালা প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সমস্যা সমাধানের জন্যই চুক্তি করেছি। তাই চুক্তি বাস্তবায়ন করার দায়িত্বও আমাদের। পার্বত্য শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ইতোমধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করেছি। ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকী ৯টি ধারা বাস্তবায়নের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুদশক পূর্তি উপলক্ষে শুক্রবার সন্ধ্যায় ৬টায় বঙ্গভবন থেকে সরাসরি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাঙামাটি,খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে সুধীজনদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
এসময় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিংসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী।
এরপরে রাঙামাটি মারী স্টেডিয়ামে আয়োজিত ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হন সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী আজাদুজ্জামান নূর এমপি। তিনি বলেন, শান্তিচুক্তির রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই পাহাড়ে শান্তি এসেছে। তাই চুক্তির ২০ বছর পুর্তির প্রাক্কালে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় আনন্দ সমাবেশ আয়োজন করেছি।
এসময় রাঙামাটিতে অন্যান্যর মধ্যে উপস্থিত ছিলেন,রাঙামাটি আসনের সাংসদ উষাতন তালুকদার, সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ ফিরোজা বেগম চিনু, চট্টগ্রাম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার, সাংস্কৃতিক মন্ত্রনালয়ের সচিব ইব্রাহিম হোসেন খান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আব্দুল মান্নান, আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য দীপংকর তালুকদার, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা, রাঙামাটি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম ফারুখ, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান, চট্টগ্রাম পুলিশের ডিআইজসহ প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তরা।
আলোচনা সভা শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এতে গান পরিবেশন করেন শিল্পী মমতাজ, কনকচাপা ও স্থানীয় শিল্পীরা। এছাড়া চিত্র নায়ক ওমর সানি ও চিত্র নায়িকা মৌসুমী নৃত্য পরিবশেনা করেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর ভাষন শেষ হওয়ার পর আতজবাশিতে পুরো স্টেডিয়াম আলোকিত হয়ে উঠে। এসময় স্টেডিয়াম লোকারণ্যতে পরিণত হয়।
চুক্তির সিংহভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে উল্লেখ প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর বহুদেশে চুক্তি হলেও আমাদের মতো এতদ্রুত কেউ বাস্তবায়ন করেনি। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য উপকমিটি গঠন করেছি বলেই এতদ্রুত এতগুলো ধারা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। তবে ২০০১ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় না আসায় চুক্তি বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছে। তবে সংবিধানের বাইরে কিছু করা হবে না।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, চুক্তির বাইরেও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য কাজ করেছি। দীর্ঘদিন পাহাড়ে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। দুদশক ধরে আমরা নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছি। পাহাড়ের মানুষ মাতৃভাষায় শিক্ষা অর্জণের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছি। দুর্গম এলাকায় আবাসিক স্কুল স্থাপন করে দিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে যেভাবে হত্যা-ক্যু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়, তেমনি পার্বত্য এলাকায়ও আত্মঘাতী সংঘাত শুরু হয়। একটা সময় ছিল, পার্বত্য এলাকায় গেলেও দুপুর ৩টার মধ্যেই ফিরে আসতে হতো।
তিনি বলেন,৭৫ পরবর্তী সামরিক সরকারগুলো পাহাড়ে সেটেলার বাঙালি বসতি স্থাপন করতে গিয়ে দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটান উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আমি পার্বত্য সমস্যাকে “রাজনৈতিক” বলে বিবেচনায় নেই। সেই অনুযায়ী আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজতে থাকি।
তিনি বলেন, আগে সাজেক যেতে ৭দিন লাগতো পায়ে হেটে যেতে, এখন সেখানে গাড়িতে যাওয়া যায়। পর্যটনেও ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। সেনাবাহিনী প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে চলেছে। সড়ক ও ব্রীজ হওয়ায় পাহাড়ের কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে। পাহাড়ে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছি। ২০০৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে মোবাইল প্রযুক্তি উন্মুক্ত করে দিয়েছি। নিরাপদ খাবার পানি, যেখানে বিদ্যুতের অভাব সেখানে সোলার দিয়েছি ও চাকরির কোটা পূরণ করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চুক্তির পর ১৯৯৮ সালে ১০ ফেব্রুুয়ারী আমরা যেদিন অস্ত্র সমর্পণের অনুষ্ঠান করি, সেদিন বিএনপি হরতাল ডাকে। অস্ত্র সমর্পণে বাধা দেওয়া ছিল তাদের উদ্দেশ্য। আমার মনে হয় তারা অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা কতো অপপ্রচার করেছিল, বলেছিল চুক্তি হলে পুরো ফেনী পর্যন্ত ভারতের অংশ হয়ে যাবে। এমনকি ভারতের একটি পতাকাও তারা বানিয়েছিল, যেটা আমাদের গোয়েন্দারা চিহ্নিত করে ফেলেন।
চুক্তির বাইরেও সরকার পার্বত্য জনপদের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চাকরির ক্ষেত্রে পার্বত্য-বাসীর জন্য কোটার ব্যবস্থা করেছি। দেশে সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। সেজন্য পার্বত্য জনপদকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করারও ব্যবস্থা নিয়েছি আমরা। যেন আমাদের সন্তানরা নিজেদের এলাকায় থেকেই পড়াশোনা করতে পারে। তিনি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে পার্বত্যাঞ্চলের বাসিন্দাসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা কামনা করেন ।
প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে প্রথমেই বীর বাহাদুর বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, অতীতে কোন সরকার পাহাড়ের মানুষের মনের কথা বুঝতে পারেনি। ২ যুগ ধরে বন্দুকের মাধ্যমে যে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি তা প্রধানমন্ত্রী সম্পন্ন করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে “ব্লেইম গেম” না করে সরকারকে সহযোগিতা করার আহবান জানান তিনি। এসময় প্রধানমন্ত্রীর সৎ ও পরিশ্রমী নেতৃত্বের প্রশংসাও করেন তিনি।
উল্লেখ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশী সময় ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাত অবসানের লক্ষ্যে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই হয়।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.