সারা গ্রাম জুড়ে প্রবারণা পূর্ণিমার উৎসবের আমেজ। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব এই প্রবারণা পূর্ণিমা প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে বছরে একবার মাত্র অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তাই সবার মাঝে সাজ সাজ অবস্থা। তবে মিত্রা চাকমার সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। নীরবে এক মনে টুক টুক করে বুনে চলেছেন বেইন(কোমর তাঁত)। কারণ এই বেইনের প্রতিটি সূতায় গাঁথা রয়েছে তাঁর সংসারের স্বপ্ন। ১০ অক্টোবর (শুক্রবার) রাঙামাটি শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে সরেজমিনে রাঙাপানি গ্রামে গিয়ে মিত্রা চাকমাকে এ অবস্থায় দেখা গেছে। শুধু মিত্রা চাকমা নন, আরও কয়েকজন নারী বেইন বুননের মাধ্যমে সংসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। নারীদের সংগ্রামী জীবনের কথা লেখবো বলে জানালে একটু লাজুক ভঙ্গীতে মিত্রা চাকমা বলেন, ‘বেইন আমার জীবন সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার। আমি যত কাজ করবো আমার সংসার তত ভালোভাবে চলবে।’ তিনি জানান, গত পাঁচ বছর ধরে তাঁর স্বামী পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত। স্বামী রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে তিনি দমে না গিয়ে সংসারের হাল ধরেছেন। সংসারের যাবতীয় দায়দায়িত্ব, সামাজিকতা রক্ষা ও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ তাঁকেই বহন করতে হয়। চার সদস্যের পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ হলেন তিনি। মিত্রা চাকমা বলেন, ‘আমি ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে চাই। দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে মেয়েটি মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে আর ছেলে গ্রামেরই যোগেন্দ্র দেওয়ানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে।’ সংসার কীভাবে চলে এ প্রশ্নের সহজ সরল উত্তরে মিত্রা চাকমা জানান, তাঁর একমাত্র আয়ের উৎস কোমর তাঁতে ‘পিনোন’ (আদিবাসী নারীদের পরনের কাপড়ের নিচের অংশ) ও ‘খাদি’ (বক্ষ বন্ধনী) তৈরি। এসব কাপড় বুনন শৈলী আর নকশার ওপর দাম নির্ভর করে। প্রতিমাসে তিনি দুই থেকে তিনটি খাদি আর দুইটি পিনোন তৈরি করতে পারেন। সূতাসহ অন্যান্য সামগ্রীর খরচ বাদ দিয়ে সব মিলিয়ে মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা আয় হয়। টানাপোড়েনের সংসারে তাঁর আয়ই প্রধান ভূমিকা রাখে এটাই তাঁর স্বস্তি বলে মিত্রা চাকমা উল্লেখ করেন। একই গ্রামের ষাট বছর বয়স্ক নোআবি চাকমা বয়সের কারণে বেইন বুনতে পারেন না। তবে সূতা তুম করাসহ বুননের প্রাথমিক কাজগুলো করে আয় রোজগার করছেন। তিনি জানান, দুই বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর বড় মেয়ের জামাইয়ের বাড়িতে উঠেছেন। তাঁর দুই ছেলে দুই মেয়ে থাকলেও বিয়ের পরে সবার যার যার সংসার নিয়ে হিমশিম অবস্থা। তাই তাঁদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে না থেকে যা পারেন বেইন বুনার প্রাথমিক কাজগুলো করে টাকা আয় করেন। তাতে নিজের খরচটা চলে। রাঙাপানি গ্রামের মিত্রা চাকমা ও নোআবি চাকমা ছাড়াও অন্যান আদিবাসী নারীরা জানান, তাঁরা বেইনের মাধ্যমে কাপড় তৈরির কাজে কোনো সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার সহায়তা পান না। আগে বিভিন্ন সমিতির কাছ থেকে ঋণ নিলেও এখন আর নেন না। তার প্রধান কারণ সুদের হার বেশি। ঋণ নিয়ে কাজ করলে লাভের অংশ আর থাকে না। সরকার বা কোনো সংস্থা স্বল্প বা বিনা সুদে ঋণ দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা দিলে কোমর তাঁত শিল্পকে বড় পরিসরে বেগবান করা যাবে বলে আদিবাসী নারীরা দৃঢ়তার সঙ্গে জানান।
–হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.
***(ইউএনডিপি-সিএইচটিডিএফের সহায়তায় বেসরকারি সংস্থা প্রোগ্রেসিভের ‘ভবিষ্যত প্রতিকুলতা মোকাবেলায় নারী’ প্রকল্পের আওতায় ‘ফটো ও কমিউনিটি সাংবাদিকতায় নারী’ শীর্ষক প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহনকারাী হেলি চাকমার সরেজমিনে মাঠ পরিদর্শনের লেখা ফিচারটি ছাপানো হল)