পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন ও এ লক্ষ্যে সময়সূচি-ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ ঘোষণা, আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত ভূমি অধিকারের প্রতি সম্মানপ্রদর্শন ও বাস্তবায়ন, বেহাত হওয়া সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জায়গা-জমি পুনরুদ্ধার ও ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য ভূমি কমিশন গঠন এবং অর্পিত সম্পত্তির নামে বেহাত হওয়া সমতল অঞ্চলের আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের ভূমি ফেরত দেয়ার কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া ইত্যাদি সপারিশ করা হয়েছে।শনিবার ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশের আদিবাসীদের এবং মানবাধিকার সুরক্ষা নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা এসব সুপারিশ করেছেন।বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের রিপন চন্দ্র বানাই এক প্রেস বার্তায় বলা হয়, কাপেং ফাউন্ডেশন ও জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র নাথ সরেনের সভাপতিত্বে সম্মানিত অতিথি ছিলেন আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহবায়ক ফজলে হোসেন বাদশা, এমপি। আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট লেখক, কলামিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ও সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা। কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমার সঞ্চালণায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা মঙ্গল কুমার চাকমা। স্বাগত বক্তব্য দেন এএলআরডির উপ-পরিচালক রওশন জাহান মনি।সেমিনারে বক্তাদের সুপারিশমালায় আরও বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি এবং ৩০ জুলাই ২০১২ তৎকালীন আইনমন্ত্রীর সভাপতিত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্ত:মন্ত্রণালয় সভায় চূড়ান্তভাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৩-দফা সংশোধনী প্রস্তাব মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ সংশোধন,আইএলও কনভেনশন নং ১০৭ ও ইউএনড্রিপে সন্নিবেশিত আদিবাসীদের ভূমি অধিকারের সাথে সঙ্গতি বিধানের লক্ষ্যে ১৯৫০ সালের পূর্ববঙ্গ জমিদারী দখল ও প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন এবং এই আইন সমতল অঞ্চলের সকল জেলায় যথাযথভাবে কার্যকর করা,আদিবাসী অঞ্চলে সরকারি ও বেসরকারি কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে আদিবাসীদের স্বাধীন মতামত গ্রহণ এবং প্রকল্পে আদিবাসীদের অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, নারীর উপর সহিংসতাসহ আদিবাসীদের উপর ভূমি কেন্দ্রীক হামলার ঘটনা যথাযথ তদন্ত ও হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান এবং আদিবাসী অধিকার আইন প্রণয়ন ও আদিবাসী অধিকার বিষয়ক জাতীয় কমিশন গঠন করতে হবে।দিন ব্যাপী সেমিনারে রাজশাহীর গনেশ মাঝি, দিনাজপুরের অধ্যাপক গনেশ সরেন, কুলাউড়ার বাবলী তালাং, বান্দরবান থেকে আসা সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের মংনু মারমা, এ্যাডভোকেট রবীন্দ্র ঘোষ, শিশির ডিও, মতিলাল হাজংসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে আগত আদিবাসী নেতৃবৃন্দ মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন।সেমিনারে মূল প্রবন্ধে কাপেং ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা মঙ্গল কুমার চাকমা বলেন, আদিবাসী চিরায়ত ভূমি অধিকার দেশের প্রচলিত আইনে স্বীকৃতি থাকলেও তার বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ উল্টো বলা যায়। আদিবাসীদের চিরাচরিত ভূমি অধিকারকে সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন করে তাদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত পূর্বক সম্মতি ব্যতীত তাদের ভূমি ও ভূখ-ে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা, অস্থানীয়দের অভিভাসন, নানা উন্নয়ন প্রকল্পের নামে তাদের ভূমি, বন ও পাহাড় কেড়ে নেয়া হচ্ছে। ১৯৫০ সালের পূর্ববঙ্গ জমিদারী দখল ও প্রজাস্বত্ব আইনকে লঙ্ঘন করে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের যোগসাজসে অসাধু উপায়ে সমতল অঞ্চলে আদিবাসীদের জমিজমা অআদিবাসীদের নিকট হস্তান্তরিত হচ্ছে। ইকো-পার্ক, জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য, কয়লা-তেল-গ্যাস উত্তোলনের নামে চিরায়ত জমিজমা থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর একটি ভূমিগ্রাসী প্রভাবশালী গোষ্ঠী আদিবাসীদের জমি ছলে-বলে-কৌশলে জবরদখল করে চলছে। প্রশাসনের দারস্থ হলেও তার কোন প্রতিবিধান পাওয়া যায় না। প্রশাসন তথা রাষ্ট্র আদিবাসীদের ভূমি সংরক্ষণে এগিয়ে আসে না বললেই চলে। প্রথাগত ভূমি অধিকার সংরক্ষণে লড়াইসংগ্রাম করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে আলফ্রেড সরেন, পিরেন স্নাল, গিতিদা রেমা, চলেশ রিচিল প্রমুখ আদিবাসী অধিকার কর্মীদের।বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং তার বলেন, রাষ্ট্র আদিবাসীদের ধোকা দিচ্ছে, বারবার আদিবাসীরা প্রতারিত হচ্ছে, বিগত যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে আদিবাসীরা সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। তিনি আদিবাসীদের প্রথাগত ভ’মি অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য এবং রাষ্ট্রকে আরোও মানবিক হওয়ার জন্য তিনি আহবান জানান।এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ২০০৮ সালে ও সর্বশেষ নির্বাচনী ইশতেহারে বর্তমান সরকার বিভিন্ন রকম প্রতিশ্রুতি প্রদান করলেও এখন পর্যন্ত তার একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি আদিবাসীদের এলাকায় বিভিন্ন প্রকল্পের নামে, সেনাক্যাম্প সম্প্রসারনের নামে ভূমি দখলের যে প্রক্রিয়া চলছে তাতে শিগ্রই আদিবাসীরা এদেশ থেকে হারিয়ে যাবে বলে মনে করেন। তিনি অতিসত্তর পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য এবং আদিবাসীদের অধিকার বঞ্চিত হলে অন্যদের অধিকারও বঞ্চিত হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।আদিবাসী শ্রী শক্তিপদ ত্রিপুরা তার বক্তব্যে বলেন, ভূমি সমস্যা আদিবাসীদের প্রধান সমস্যা, ভূমিকে কেন্দ্র করেই সকল প্রকার অপরাধ আদিবাসীদের উপর সংগঠিত হচ্ছে, আদিবাসীদের জন্য পৃথক আইন থাকলেও সরকার তা পালন করছে না। তিনি বলেন, অপরাধিদের কোন বিচার না করার কারনে তারা আরও উৎসাহিত হচ্ছে, এসময় তিনি পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।সেমিনারে সম্মানিত অতিথি ফজলে হোসেন বাদশা এমপি বলেন, আদিবাসীদের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি খুবই নাজুক, দিন দিন আদিবাসীরা এদেশে সংখ্যা লঘু থেকে লঘুতর পরিণত হচ্ছে। তিনি আদিবাসীদের সার্বিক পরিস্থিতির উপর আলাদাভাবে প্রতিবেদন তৈরি করে তা সারাদেশে প্রকাশ এবং তা আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার করার পরামর্শ দেন। তিনি আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধানে ভূমি কমিশন আইন যথাযথভাবে কার্যকর এবং সমতল ভূমির জন্য আলাদা কমিশন গঠন ও আদিবাসী অধিকার আইন প্রনয়নের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য রাষ্ট্র আদিবাসীদের সংখ্যালঘুদের নির্মূলের ষড়যন্ত্র ও সরকার গণবিরোধী আচরণ করছে বলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আদিবাসীদের রক্ষাকবচ হিসেবে পার্বত্য চুক্তি ম্যানোয়াল ১৯০০, প্রজস্বত্ব আইন ১৯৫০ ও পার্বত্য চুক্তি ১৯৯৭ থাকলেও রাষ্ট্র তা লঙ্ঘন করছে। তিমি এই সরকারকে সাম্প্রদায়ীক, আমলানির্ভর, উপনিবেশিক আখ্যাদেন এবং এ পর্যন্ত যতগুলো আদিবাসীকে হত্যা করা হয়েছে, যতগুলো অপরাধ সংগঠিত হয়েছে তার গণতদন্ত কমিশন করার আহবান জানান।বিশিষ্ট লেখক, কলামিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, যেভাবে আদিবাসীরা এদেশ থেকে পালাতে বাধ্য হচ্ছে তাতে ২০২১ সালের পর আর এদেশে আদিবাসী থাকবে কিনা না বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আদিবসীদের মানবাধিকার তথা ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান।
–হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.