দ্রুততম সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন দাবি জানিয়েছে সুধাসিন্ধা-রুপায়ন দেওয়ানের নেতৃত্বাধীন এমএন লারমা গ্রুপের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি(পিসিজেএসএস)। সমিতির পক্ষ থেকে সরকারসমূহের সদিচ্ছার অভাবের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বিগত ১৭ বছরেও বাস্তবায়িত হতে পারেনি অভিযোগ করে বলা হয়েছে, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। তাই সকল পক্ষের রাজনৈতিক-জাতিগত-আদর্শগত ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এটিই উপযুক্ত ইস্যু। একমাত্র ব্যাপক জুম্ম জনগণের বলিষ্ঠ আওয়াজই এই ঐক্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আগামী ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৭তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এমএন লারমা গ্রুপের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে শনিবার ই-মেইল বার্তায় বিভিন্ন গনমাধ্যমের কাছে পাঠানো লিফলেট সম্বিবলিত বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সরকারসমূহের সদিচ্ছার অভাবের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বিগত ১৭ বছরেও বাস্তবায়িত হতে পারেনি। চুক্তিস্বাক্ষরকারী আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম দফায় ৩ বৎসর ২ মাস, ২য় দফায় ৫ বৎসর ও চলতি দফায় ১০ মাস অর্থাৎ মোট ৯ বৎসর সময় পেয়েও চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি এবং মৌলিক বিষয়সমূহ অবাস্তবায়িত অবস্থায় ফেলে রেখেছে। বিগত মেয়াদে ‘সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক’ ও চলতি মেয়াদে ‘অক্ষরে অক্ষরে চুক্তি বাস্তবায়ন করা’র প্রতিশ্রুতি এই ধরণের বক্তব্যের বিপরীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ অব্যাহত গতিতে চলছে, বিভিন্নভাবে জুম্মদেরকে ভূমি হতে বিতাড়িতসহ মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। বিগত মেয়াদকালের মতো ভূমি-কমিশনের বিতর্কিত আইন সংশোধন না করে শুধুমাত্র এই কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা ইত্যাদি কারণে জুম্মজাতির মানুষ দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছেন। সুতরাং, চুক্তি বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ না করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি বিস্ফোরিত হওয়ার পূর্বেই দ্রুততম সময়ে যথাযথ চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানাই। অন্যথায়, পরিস্থিতির অবনতির দায়-দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে। বিবৃতিতে দাবি করা হয়, সরকার মিছেমিছি আন্দোলনকে প্রলম্বিত হতে দিয়েছিল, যার কারণে গরীব জনগণের ট্যাক্সের টাকায় গড়া রাষ্ট্রীয় তহবিল হতে আন্দোলন মোকাবেলায় সামরিক খাতে দৈনিক সোয়া এককোটি টাকা ব্যয়িত হয়েছে। অবশেষে ১৯৯৬ সনের নির্বাচনে বিজয়ী সরকার জেএসএস এর প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে এবং ১৯৯৭ সনের ২ ডিসেম্বর বহু কাঙ্খিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিরভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হলেও পরিষদ-আইনের ২২ নং ধারা অনুযায়ী ৩ পার্বত্য জেলার উন্নয়ন, সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ইত্যাদির উপর তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় এর দায়িত্ব প্রতিপালন করতে দেয়া হচ্ছে না এই পরিষদকে। ভূমি-কমিশন গঠন করা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে আইনটি তৈরী না হওয়ায় এবং বিগত সরকারের আমলে চুক্তি অনুযায়ী এই আইনটি সংশোধন করার প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও তা কার্যকর না হওয়ায় সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ইস্যুটি ঝুলিয়ে রাখায় প্রায় দেড় লক্ষ জুম্ম নিজ বাস্তুভিটায় ফিরতে পারছেন না। সরকারের আহ্বানে ভারতের শিবির হতে স্বউদ্যোগে প্রত্যাবর্তনকারী কয়েক হাজার জুম্ম শরণার্থী সরকারপ্রতিশ্রুত সরকারী রেশন পাচ্ছেন না। বিদ্যমান আইনেরভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের নিয়ে একটি ভোটার তালিকা না করায় ৩ টি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন হতে পারছে না। বিদ্যমান আইনে বলবৎ পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতায় পুলিশ (স্থানীয়) গঠিত না হওয়ার কারণে সাম্প্রদায়িক আস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না। বছরের পর বছর সেনাকর্তৃত্ব বলবৎ থাকায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও গড়ে উঠতে পারছে না। বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনতান্ত্রিক মর্যাদা খর্ব করা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বন্টনে বৈষম্যসহ ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসন পরিচালনা ও বাঙালী-মুসলিম অনুপ্রবেশকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে ‘ইন্ডেজেনাস হিল পিপল’দের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের নীলনকশা শুরু হয় পাকিস্তানের সূচনাকাল থেকে। এইসব ষড়যন্ত্রের রূপকাররা পাকিস্তান সংবিধানের নির্দেশনা জনমত গ্রহণের বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘ট্রাইবাল এরিয়া’র মর্যাদা বাতিল করেন। অথচ একই শাসনতান্ত্রিক মর্যাদা পশ্চিম পাকিস্তানে বলবৎ থাকে। বাংলাদেশের জন্মলাভের পরপরই পার্শ্ববর্র্তী জেলাসমূহের শতশত আগ্রাসী আক্রমণকারীর সংঘবদ্ধ আক্রমণে, বিশেষ করে বর্তমান খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড়, মাটিরাঙ্গা, গুইমারা ও রামগড় থানার শতশত জুম্ম জনপদ ধ্বংস ও বেহাত হয়ে যায়। এইসব জমি ও গ্রাম ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা কার্যকর করেনি। এই সময়েই জাতিবিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে সংঘটিত করা হয়েছিল গণহত্যা। ১৯৭২ সনে সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনতান্ত্রিক মর্যাদার দাবী প্রত্যাখ্যাত হয় ও ‘ইন্ডেজেনাস হিল পিপল’দের জাতিপরিচিতিকে অস্বীকার করা হয়। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ১৯৭২ সন হতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মজনতা বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা-মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস এর পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হন। ১৯৭৩ সনে বাংলাদেশের প্রথম সংসদীয় নির্বাচন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ মর্যাদার অনুকূলে জেএসএস প্রার্থী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও চাইথোয়াই রোয়াজাকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করে। শাসকগোষ্ঠীর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার বাস্তবতা অনুধাবনে ব্যর্থতাই পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র লড়াই শুরুর মূল কারণ। সরকারসমূহ এ সমস্যা ‘সমাধানে’ আন্দোলনকে অবদমিত করার প্রয়াস চালায়। বার বার রাষ্ট্রীয় সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। ছাত্র-যুবাদের আন্দোলনবিমুখ ও নৈতিক অবক্ষয় ঘটানোর উদ্দেশ্যে ‘ক্লাবসংস্কৃতি’ জন্ম দেয়ার পাশাপাশি উদার হস্তে চাকুরী বিলানোসহ জানা-অজানা অনেক ষড়যন্ত্র, পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে পরিণত করার জন্য পাকিস্তানের সূচনালগ্নের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখা হয়েছে। জেএসএস এর বিদ্রোহীধারার সঙ্গে ‘চুক্তি’ স্বাক্ষর করে একই সঙ্গে ২৩৩ জন সশস্ত্র বিদ্রোহীকে ‘স্বাভাবিক’ জীবনে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। জেএসএস-কে পাশ কাটিয়ে ৩ টি স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু, কোন সরকারই সশস্ত্র আন্দোলনের বোঝা ঘাড় হতে ফেলতে পারেনি। বিবৃতিতে দাবি করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আওতায় জেএসএস এর অস্ত্র জমাদানের পরবর্তী সময়ে সরকারী দলের ও সরকারের কিছু পক্ষ চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। বিগত ২ বৎসর মেয়াদী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন দায়িত্ববান উপদেষ্টাও প্রকাশ্যে চুক্তির কিছু মৌলিক বিষয়, তাঁর ভাষায় ‘রিভ্যু’ (পুনর্বিবেচনা) করার কথা বলেছিলেন। তাঁরা চুক্তির সকল মৌলিক বিষয় বাতিল করতে চান। প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে সরকারপক্ষ ৯ দফা রাজনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই ৯-দফা রাজনৈতিক প্রস্তাবের ও ওভারগ্রাউন্ড সামাজিক-রাজনৈতিক জুম্মনেতাদের ৩ টি জেলা পর্যায়ের কমিটির সঙ্গে সরকারী কমিটির যে পৃথক ৩ টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেই চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ ১৯৯৮ সনের স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনসমূহে ও জেএসএস-বাংলাদেশ সরকার এর চুক্তিতে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। কিন্তু চুক্তিত্তোরকালে এই নিষ্পন্ন হওয়া বিষয়গুলো প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে। এসবের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হচ্ছে, পুলিশ (স্থানীয়) গঠন ও পরিচালন, যেটা ১৯৮৯ সনের আইন কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। ভূমি-ব্যবস্থাপনার উপর পার্বত্য জেলা পরিষদের এক্তিয়ার, ১৯৮৯ সনের আইনের ৬৪ ধারায় স্বীকৃত হয়েছে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত শান্তি-সংলাপে সরকারের ৯ দফা রাজনৈতিক প্রস্তাবের রূপরেখায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি ‘বিশেষ এলাকা’ হিসেবে স্বীকৃতির কথা বলা হয়েছে। ১৯৯৭ সনে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে তা ‘উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং ১৯৮৯ সনের স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনে স্থানীয় সরকার পরিষদের চেয়ারম্যান পদটি ‘উপজাতি’ প্রার্থীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। তবে ১৯৮৯ সনে যাঁরা এসবে সম্মত হয়েছিলেন, এখন তাঁরাই এসব বিরোধিতা করছেন।
–হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.