প্রতি বছরের মতো এবারও খাগড়াছড়ির রামগড়ে বারুণী স্নানোৎসব উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের লক্ষাধিক দর্শনার্থী-পুণ্যার্থীর সমাবেশ ঘটে। মধু কৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে ফেনী নদীর সাবরুম - রামগড় বাজার ঘাট অংশে রোববার ২৬মার্চ এই বারুণী স্নান মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
যুগ যুগ ধরে উদ্যাপিত এই মহামিলন মেলা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ও পাহাড়ি-বাঙ্গালীর সমন্বিত অংশ গ্রহণে এক সর্বজনিন মহোৎসবে রুপ নেয়। পুণ্য স্নান ছাড়াও এই সময় দুই দেশের ঔৎসুক্য মানুষ একে অন্যের দেশে বেড়াতে গিয়ে পরিচিতদের সঙ্গে ভাব বিনিময় এবং নিজেদের পছন্দ মত পন্য সামগ্রী ক্রয় করার সুযোগ পান। বলা যায় কিছুটা সময়ের (সকাল-সন্ধ্যা) জন্য আবেগাপ্লুত প্রতিবেশির দুই দেশে সুখকর বিচরণের এক অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। আত্মীয়-পরিচিতদের সঙ্গে আবেগ মাখানো দেখা সাক্ষাৎ কুশল বিনিময় ও পছন্দনীয় দ্রব্য সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় বারুণী স্নানের যেন অনিবার্য অংশ।
রামগড় শ্রীশ্রী দক্ষিণেশ^রী কালি মন্দিরের প্রধান পুরোহিত মৃদুল চক্রবর্তী জানান, বিশুদ্ধ পঞ্চিকা মতে তিথি নক্ষত্রের সঙ্গে মিলিয়ে নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী সনাতন ধর্মাবলম্বী ভক্তবৃন্দ বৈদিক মন্ত্র পাঠ করে নদীর পুণ্য সলিলে অবগাহন করেন এই দিনে। এ সময় পুণ্যার্থীরা নদী তীরে গঙ্গা পুজা ও পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য তর্পণ সহ নানা ধর্মীয় অনুষঙ্গে বিভিন্ন আচার-উপাচারে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। ধর্মানুরাগীদের বিশ্বাস তিথি-লগ্ন অনুযায়ী পুণ্য স্নানে মনের কুটিলতা সংকীর্ণতা,পাপমোচন ও মনোবাসনা পূর্ন হয়। শাস্ত্রে আছে, “মহাবারুণী গঙ্গা স্নানে কোটি সূর্য্যগ্রহণকালীণ স্নানের জন্য ফল সমফলম্”।
বারুণী স্নানোৎসব প্রসঙ্গে রামগড় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. মফিজুর রহমান জানান, বৃহত্তর পার্বত্য চট্রগ্রামের রামগড় ছাড়া পাহাড়ি এলাকার অন্য কোথাও এতোটা জাঁকজমক ও লোক-লোকারণ্যে বারুণী মহাপুণ্য স্নান অনুষ্ঠিত হওয়ার খবর জানা নেই। যে কারণে এখানে এতো লোকের সমাবেশ ঘটে। ফেনী নদীর সাবরুম-রামগড় বাজার ঘাট অংশে প্রতিবছর দুই দেশের পুণ্যার্থীরা স্নানোৎসবে মিলিত হন। তিনি নিজেও দুই বছর মেলা উপলক্ষ্যে ভারতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। এই নদীটি বাংলাদেশ-ভারত সীমানার শূণ্যরেখায় প্রবাহিত। নদীর দক্ষিণাংশ বাংলাদেশ ও উত্তরাংশ হয়ে ভারতের সীমানা শুরু।
রামগড় বাজার ঘাট এলাকার স্থায়ী বাসিন্ধা প্রবীণ ব্যবসায়ী গৌর হরি দাশ (৯০) এর ভাষ্যমতে, ফেনী নদীর রামগড়-সাবরুম অংশে ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই বারুণী স্নান হতো। তিনি নিজেও প্রতিবছর এ স্নানে অংশ নিয়েছেন। ওই সময় অবশ্য এই এলাকায় লোকসংখ্যা ছিল খুবই কম। তারপরও বলা যায়, রামগড় বারুণী মেলা হচ্ছে শত বছরের ঐতিহ্য।
রামগড় ১৯২০ সালের সাবেক মহকুমা শহর। প্রাচীণ এই ঐতিহাসিক জনপদের বি¯তৃতি ছিল বর্তমান খাগড়াছড়ির পুরো এলাকাসহ রাঙ্গামাটির মারিশ্যা পর্যন্ত। রামগড়,বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি এই তিন মহকুমা নিয়ে ছিল পার্বত্য চট্রগ্রাম। পাকিস্তান আমলেও বিক্ষিপ্তভাবে যে যার মতো নদীর বিভিন্ন অংশে পুণ্য স্নানে অংশ গ্রহণ করতো। তবে কিছুটা কড়াকড়ি ছিল। স্বাধীনতার পর থেকে বেশ কয়েক বছর ধরেই উৎসাহ-উদ্দীপনায় এখানে পুণ্য স্নান হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে দর্শনার্থী ও পুণ্যার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় আশির দশকে ফেনীনদীর রামগড়ের বাজার ঘাট অংশটি পুণ্য স্নানের জন্য অনেকটা স্থায়ীভাবেই বেছে নেওয়া হয়। সেই থেকে প্রতিবছর এখানে স্বতস্ফূর্ত লোকসমাবেশের মধ্যদিয়ে বারুণী স্নানোৎসব হতে দেখা যায়।
রামগড়ের বিশিষ্ট পাহাড়ী নেতা সাবেক খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ সদস্য চৌধুরানী পুত্র (ঐতিহ্যময়ী মারমা ডাইন্যাষ্টি) মংপ্র“ চেীধুরী জানান, বারুণী স্নানের ধর্মীয় আচার অনুসঙ্গের দিকটি ছাড়াও এর অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে এই দিন এক দেশের মানুষ অন্য দেশে বেড়ানোর সুযোগ পান এবং পারস্পরিক উপহার সামগ্রী বিনিময় করেন। হিন্দু,মুসলিম,বৌদ্ধ খ্রিস্টান, পাহাড়ি-বাঙ্গালি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন বারুণী মেলায়। রামগড় সনাতন সমাজ কল্যাণ পরিষদের সাধারন সম্পাদক দেবব্রত শর্মা ও সাংগঠনিক সম্পাদক লিটন দাশ বলেন, দূর-দুরান্তের অনেক দর্শনার্থীই এই বিশেষ দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন। বিভিন্ন স্থান থেকেও দর্শনার্থীরা স্নানোৎসব ও মেলায় অংশ নেওয়ায় বারুণীর শুভক্ষণে পুরো রামগড় জুড়ে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে।
রামগড়ের আশপাশ ছাড়াও ফটিকছড়ি, মানিকছড়ি , গুইমারাসহ পুরো খাগড়াছড়ির দূর-দুরান্তের অনেকে আসেন। বৃহত্তর চট্রগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী জেলা থেকেও অনেকে রামগড় বারুণী স্নানোৎসবে অংশ নেন। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী রামগড়ের এই বারুণী স্নানোৎসব লক্ষ প্রাণের পদ চারনায় মুখড়িত মুর্হূতগুলো ভরিয়ে রাখে আনন্দ উচ্ছ¡াসে- এক স্বর্গীয় মহিমায়।
রামগড় উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আবদুল কাদের এ প্রসঙ্গে বলেন,দুই দেশের মানুষের আবেগ, অনুরাগ ও ধর্মানুভূতির কারণে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুণ্যার্থী-দর্শনাথীদের সার্বিক সহযোগিতা দেন। কোন ধরনের বাঁধার সৃষ্টি করেন না। ওই সময় এঁরা অনেক আন্তরিক ও নমনীয় থাকেন। তিনি জানান, এবার এক লাখেরও বেশি মানুষের সমাবেশ ঘটেছে এখানে।
রামগড় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাইন উদ্দিন জানান, এতো মানুষের সমাবেশ হওয়া সত্তে¡ও কোথাও কোন ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। সবকিছু সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ফটিকছড়ির হেয়াকো বনানী ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক বটন কান্তি দে ও বিশ্ব নাথ দে এই প্রতিবেদককে বলেন দুএকবছর বাদ দিয়ে প্রতিবারই রামগড়ের বারুণী উৎসবে তাঁদের আসা হয়েছে। হাজারো মানুষের আনন্দ-উচ্ছাসে মাতোয়ারা থাকে তখন পুরো এলাকা।
সাবেক খাগড়াছড়ি জেলা তথ্য কর্মকর্তা সুরেশ মোহন ত্রিপুরা বলেন, দু দেশের মানুষে রামগড় ও সাবরুম বাজার লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। আত্বীয় স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাত হয়, কুশল বিনিময় করেন একে অন্যের সঙ্গে। ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণাংশে বসতি স্থাপনকারী বাঙ্গালীদের প্রায় সবারই আদিবাস ফেনী, নোয়াখালী, সীতাকুন্ড, মীরশরাই, কুমিল্লা প্রভৃতি আশপাশ এলাকার। তাই শেকড় এর টানে একবার হলেও এই সুযোগে বাংলাদেশ ঘুরে যান অভিবাসনকারীরা।
রোববার (মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথি ) সরেজমিন দেখা যায়, ভারতীয় পুরোহিত প্রমোদ চক্রবর্তী ও বিবেকানন্দ চক্রবতী নদী তীরে বসে প্রার্থনারত ভক্তদের আচার অনুষ্ঠান করাচ্ছিলেন। বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী ফুল বেলপাতা,ধান,দূর্বা,হরতকী,ডাব,আমের পল্বব প্রভৃতি সহযোগে পাপমুক্ত হওয়ার বাসনায় পুণ্য স্নান করতে দেখা যায় ভক্তদের।
ভারতের বিলোনিয়া থেকে আগত বিনোদবিহারী নাথ ও মনু ঘাট এলাকার প্রমোদ দাশ জানান, রামগড়ে তাঁদের আত্মীয়-স্বজন আছেন। বারুণী স্নান ও স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ায় বেশ ভালো লাগছে তাঁদের। প্রতিবারই এই মেলায় অংশ নেন তাঁরা।
নোয়াখালীর আনোয়ার হোসেন ও চকরিয়ার প্রদীপ নাথ প্রতিবারের মতো এবারও সাবরুম গিয়ে কিছুটা সময় কাটিয়েছেন। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, মনে হলো যেন ভারত গিয়ে পিকনিক করে ফিরলেন। সাবরুম থেকে আগরতলা ১৩৩ কিলোমিটার এবং উদয়পুর ৮৩ কিলোমিটার। উদয়পুর মা কালির মন্দির হিন্দুদের মহা পবিত্র পীঠস্থান। পাসপোর্ট-ভিসার ঝক্কি ঝামেলা এড়িয়ে অনেকেই এই সুযোগে উদয়পুর কালি মন্দির দর্শন করে আসেন।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.