পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করবে আমি বিশ্বাস করতে পারি না বলে মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের জন্য এ চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল। এ চুক্তি স্বাক্ষরের পশ্চাতে ছিল একটি প্রলম্বিত আন্দোলন যার অধিকাংশ সময় ছিল সশস্ত্র অবস্থায়। কিন্তু ২১ বছর পরেও দেখা যাচ্ছে এ চুক্তির মূল লক্ষ্য পাহাড়ের মানুষেরকে একটি বিশেষ শাসন ব্যবস্থার অধীনে তাদেরকে ক্ষমতায়ন করার যে বাস্তবতা তা হয়ে উঠেনি।
রোববার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২১ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনষ্টিটিউটে জাতীয় নাগরিক উদ্যোগের আয়োজনে আলোচনা সভার সন্তু লারমা এ কথা বলেন।
আলোচনা সভায় বিশিষ্ট কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ এর সভাপতিত্বে বক্তব্যে রাখেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য, বিশিষ্ট মানবাধিকারকমীর্ এডভোকেট সুলতানা কামাল,আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক মেসবাহ কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতিড. নুর মোহাম্মদ তালুকদার। রূপশ্রী চক্রবর্তীর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন মানবাধিকারকর্মী নুমান আহম্মদ খান। এছাড়া আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কমিউনিস্ট কেন্দ্রের ডা. অসীত বরণ রায়, জনউদ্যোগ জাতীয় কমিটির সভাপতি তারিক হোসেন মিঠুল, আদিবাসী যুব পরিষদের সভাপতি হরেন্দ্র নাথ সিং।
আলোচনা সভায় প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ে বিগত নয় মাসে ৪০ জনের অধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে এটা আমাদের জন্য সুখকর নয়। পাহাড়ে সেনাবাহিনীর আচরণ পার্বত্য চুক্তির পক্ষে নয় বলেও মন্তব্য করেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি।
বিশিষ্ট মানবাধিকারকমীর্ এডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, যে দিনটি উৎযাপিত হওয়ার কথা ছিল আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে,আগামী দিনের নতুন আশা-উদ্দীপনা নিয়ে কিন্তু তা আজ পালিত হচ্ছে হতাশা ও ক্ষোভ নিয়ে।
রাজনৈতিক নেতৃত্বকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে ফিরে আসার আবেদন ও আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে অপরিসীম নেত্রী-বন্দনা রয়েছে সেটা কোনো দেশে নেই। আর অন্যদিকে এদেশে নেতার নির্দেশের সে সীমাহীন বরখেলাপও আমরা অন্যদেশে দেখতে পায় না।
পার্বত্য চুক্তি বর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে পাহাড়ের উন্নয়ন কনসার্টের তীব্র বিরোধীতা এবং নিন্দা জানিয়ে তিনি আরো বলেন, পাহাড়ের জুম্ম আদিবাসীদের প্রতারিত করে এবং হতাশার মধ্যে রেখে উন্নয়ন কনসার্টের মাধ্যমে আরেকটি প্রতারণা করা হচ্ছে।
আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, পাহাড়ে একদিকে উন্নয়নের কনসার্ট হচ্ছে কিন্তু পাহাড়ের সাধারণ মানুষের মনে এ কনসার্ট এবং উৎসব রঙ ছড়াতে পারেনি বরং চুক্তির ২১ বছর পরও পাহাড়ী আদীবাসীদের কাছে হাহাকার নিয়ে হাজির হয় এ চুক্তি বর্ষ।
তিনি আরো বলেন, এ চুক্তির ২১ বছর পর দেখা যাচ্ছে এ চুক্তি প্রতারণার, ধোঁকাবাজির, চালাকির এবং গত ১৩ বছর ধরে এ চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একই বক্তব্য দেয়া হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক মেসবাহ কামাল বলেন, কাপ্তাই হ্রদ তৈরীর মাধ্যমে পাহাড়ের মানুষের যে বঞ্চনার মহাকাব্য ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সংবিধানে যে প্রত্যাখ্যাত ও প্রতারিত হওয়ার ইতিহাস তৈরী হয়েছে তা ঘুচানোর জন্য যে শপপথ নিয়েছিল পাহাড়ের মানুষ, তাকে স্বীকার করে নিয়েই রাষ্ট্রের সাথে পাহাড়ের মানুষের মধ্যে এই চুক্তি হয়েছে।
চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না করার ক্ষোভ জানিয়ে তিনি আরো বলেন, সরকার এক কথার মানুষ হিসাবে ভূমিকা নিয়ে কেবল বলেই যাচ্ছে ৭২ টি ধারার মধ্যে ৪৮ টি ধারা বাস্তবায়ন হয়েছে। ডিসেম্বরের এই বিজয় মাসে বাংলাদেশের পতাকার সবুজের মাঝে যে লাল রক্তগৌরব সে গৌরবের অংশীদার আদিবাসীরাও বলে উল্লেখ করেন বিশিষ্ট এ আদিবাসী গবেষক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, পাহাড়ের বহুমাত্রিকতাকে মেনে নিয়ে পাহাড়ের এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু কোথায় যেন এক ধরণের গলদ রয়ে গেছে যার জন্য রাষ্ট্র ও পাহাড়ের মানুষের দাবীর মধ্যে দূরত্ব রয়ে গেছে।
কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতিড. নুর মোহাম্মদ তালুকদার তার বক্তব্যে বলেন, পাহাড়ে অনেক উন্নয়ন হয়েছে এবং একই সাথে অনেক সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যার জন্য পাহাড়ে এখনও অসন্তোষ চলছে। এ অসন্তোষ নিরসনের দায়িত্ব সরকারের ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সন্তু লারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন পুলিশ কনস্টেবল বা একজন সেনাসদস্য থেকেও আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ক্ষমতাবান না। অথচ পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ইঙ্গিত করে তিনি আরো বলেন, দেশের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনকে সামনে রেখে এযাবৎ ধরে তাদের নির্বাচনী ইশতিহারে পাহাড়ের মানুষকে নিয়ে তাদের ভাবনার কথা তুলে ধরে আসছে। কিন্তু যারাএতদিন ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে তারা কোনোদিন কথা রাখেনি। বাংলাদেশের সরকার দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন হবে বলে আমি আশা করতে ও বিশ্বাস করতে পারিনা বলেও তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
পাহাড়ের জনগণ তাঁদের জীবনকে খুঁজে নিতে আবারো নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে এবং আগামী দিনের পাহাড়ের তারুণ্য শক্তি তাদের করণীয় নির্ধারণ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন পাহাড়ের এ নেতা।
সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর সভাপতির বক্তব্যে দেশের একটি দৈনিক পত্রিকার ক্রোড়পত্র দেখিয়ে বলেন যে, এই ক্রোড়পত্রই প্রমাণ করে সরকারের মধ্যে চালাকি আছে। এখানে সরকারের প্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারের সংশ্লিষ্ট অনেকের বক্তব্য আছে কিন্তু চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী সন্তু লারমার কোনো বক্তব্য তুলে ধরা হয়নি।
বিভিন্ন দেশের অনেক চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে উল্লেখ করে আগামী দিনের রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক ইশতিহারে এ চুক্তির শতভাগ বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট দফা রাখবে বলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। এ চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আধুনিক গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে বলেও মন্তব্য করেন বিশিষ্ট এ কলামিষ্ট।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.