শনিবার রাজধানী ঢাকায় বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৩৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী নানান আয়োজনে পালিত হয়েছে।
জাতীয় কমিটির উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী কনকচাঁপা চাকমার নেতৃত্বে বিপ্লবী নেতা এমএন লারমার প্রতিকৃতি অংকন প্রতিযোগীতার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ আয়োজন। বিপ্লবী এ নেতার স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ বেদীতে জাতীয় কমিটি সহ বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক, সামাজিক ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর চারুকলার বকুলতলায় অনুষ্ঠিত হয় স্মরণ সভা।
জাতীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌসের সঞ্চালনায় জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক বিশিষ্ট কমিউনিষ্ট নেতা কমরেড মনজুরুল আহসান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রথমে শোক প্রস্তাব পাঠ করেনজাতীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মুর্শিদা আক্তার ডেইজী ।
স্বাগত বক্তব্যে দীপায়ন খীসা বলেন, জাতীয় পর্যায়ে লারমাকে স্মরণের মধ্য দিয়ে আমরা চায় প্রিয় নেতা লারমার জীবন ও দর্শন ছড়িয়ে পড়বে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
বিপ্লবী নেতার বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রোকেয়া কবীর বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আজীবন শোষিত,নিপীড়িতের কথা বলে গেছেন।তিনি সংবিধানে যে অসংগতির কথা তুলে ধরেছিলেন তা তৎকালীন সময়ের বিশিষ্ট আইনবিদ থেকে শুরু করে অনেক প্রগতিশীল মানুষও ধরতে পারেনি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম তার বক্তব্যে বলেন,আমরা এমন একটি মানুষের স্মরণ সভার আয়োজন করছি যার একটি সুদীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ঐতিহ্য আছে।তিনি কেবল নারী বা নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণীর কথা সংসদে বলেননি তিনি সেইসব নারীদের কথাও সংসদে তুলে ধরেছিলেন যারা দেহ বিক্রির কাজে জড়িত ছিলেন। তাদের জীবন বদলিয়ে ফেলার কথা তিনি তৎকালীন গণপরিষদে তুলে ধরেছিলেন অথচ আজকে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ হবে নাকি কত হবে তা সুস্পষ্টভাবে বলার মত একজন সাংসদও সংসদে নেই।
বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বিপ্লবী এ নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ঘাতকের গুলি তাঁর জীবন কেড়ে নিলেও তাঁর আদর্শকে কেড়ে নেওয়া যাইনি। তিনি বলেন, একাত্তরে আমিও অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ করেছি।আমি দুই রকমের মুক্তিযোদ্ধা দেখেছি।কেউ কেউ আদর্শিকভাবে উদ্ধুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি আবার কেউ কেউ ঘাত-প্রতিঘাতে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। এই ঘাত-প্রতিঘাতে পড়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা মানুষরা মুক্তিযুদ্ধের পরে আদর্শিক লড়াই থেকে ছিটকে পড়েছে।আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় মুক্তির জন্য । এ আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় মুক্তিকে কেবলমাত্র একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায়না। এই আদর্শটাকে সামনে তুলে ধরে লড়াইটাকে জারী রেখেছিলেন বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা।
কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান তাঁর বক্তব্যে বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা গণতন্ত্রের জন্য,মানবতার মুক্তির জন্য লড়াই করেছিলেন কিন্তু সে মুক্তি এখনো আসেনি। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আদিবাসীদের যে পরিচয়ের স্বীকৃতি চেয়েছিলেন সে স্বীকৃতি এখনো মেলেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ রাষ্ট্র আদিবাসীদের পরিচয় নির্দিষ্ট করে না দিয়ে আদিবাসী হিসেবে উল্লেখ না করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড.মুহাম্মদ সামাদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা কেবল জুম্ম জনগণের জন্য লড়াই করেননি, তিনি দেশের অপরাপর নিপীড়িত শ্রমজীবি মানুষের জন্যও কথা বলেছেন।তিনি শুধু পাহাড়ের নেতা নন, তিনি সমগ্র নিপীড়িত মানুষের এবং বাংলাদেশের জনমানুষের নেতা।
বিশিষ্ট কলামিষ্ট ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সব নেতাকে লাল সালাম জানানো হয় না।কেবলমাত্র মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মতনআদর্শিক,প্রগতিশীল,সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে, ধর্মের উর্দ্ধে ও মানবিক মনের অধিকারী নেতাকেই লাল সালাম জানানো যায়।
আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলোর আন্দোলন ও সংগ্রামকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে বামপন্থী সংগঠনগুলোর সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার বন্ধু ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, লারমা অত্যন্ত সহজ,সরল জীবন যাপন করতেন। তার এ প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর মৃত্যুর পর পাওয়া তার ব্যবহার্য কয়েকটি জিনিস দিয়ে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে পাহাড়ে ও সমতলে আদিবাসীদের উপর সহিংসতা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন রাখেন, পার্বত্য চুক্তির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন ব্যতীত, পাহাড়ের সমস্যার প্রতি বিশেষ নজর ব্যতিরেকে এবং লারমার আদর্শের কথা বলা মানুষদের আক্রান্ত করে কী পাহাড় তথা সমগ্র বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব?
বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার গড়ে তোলা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তার সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য সংসদে তথা রাজপথে অনেক কথা বলা হলেও কোনো কাজ হয়নি।তার জন্য সবাইকে একসাথে লড়াই চালিয়ে নিতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক কমরেড মঞ্জুরুল আহসান খান বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার হত্যার পেছনে দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা যেমন জড়িত ছিলেন ঠিক তেমনি রয়েছে পাহাড়ের বর্তমান সংঘাতময় পরিস্তিতির জন্যও রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র । এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে একসাথে লড়তে হবে।এ লড়াইয়ে বিজয় লাভ হলেই মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার স্বপ্ন সার্থক হবে এবং তাঁর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হবে।
এছাড়া অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির স্টাফ সদস্য চঞ্চনা চাকমা, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন,এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ(বিসিএল) এর সভাপতি শাহজাহান আলী সাজুসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
আলোচনা সভার ফাঁকে ফাঁকে বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার ৩৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটি ছাড়াও বিপ্লবী নেতার অস্থায়ী শহীদ বেদীতে পুস্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি,বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম,বাংলাদেশছাত্র ইউনিয়ন,বাংলাদেশ বৌদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিষদের নেতৃবৃন্দ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ(বিসিএল),হিল ইউমেন্স ফেডারেশন, বাসদ,ছাত্র ফেডারেশন,সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফেডারেশন,গারো স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ওয়ার্কাস পার্টি,আরডিসি,কাচালং ওয়েলফেয়ার সোসাইটি এবং রক্তদাতা সংগঠন জুবদাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
আলোচনা সভার শেষে প্রয়াত নেতার স্মরণে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয় এবং মাদল ও কপিল আহমেদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্যে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকীর দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.