পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেছেন, সামরিক, বেসামরিক যেসব কর্মকর্তারা রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে জড়িত তাদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই চুক্তির ১৭ বছর হলেও পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হচ্ছে না।গত ১৭ বছর হয়ে গেল তবুও চুক্তি বাস্তবায়নের কোন ইতিবাচক সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না উল্লেখ কে তিনি আরও বলেন, শুধুমাত্র অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার জন্যই পার্বত্য চুক্তি করা হয়েছিল। জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য যে কাজ করা দরকার ছিল তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সম্পন্ন করেছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কখনই সেটি করা হয়নি। বৃহস্পতিবার ঢাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে বিশেষ শাসন ব্যবস্থার প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসমূহের শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সন্তু লারমা এসব মন্তব্য করেন। দৈনিক ডেইলি স্টার ভবনের আজিমুর রহমান সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও কাপেং ফাউন্ডেশন যৌথ আয়োজনে আয়োজিত সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি ও কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন রবীন্দ্রনাথ সরেন। সম্মানিত অতিথি ছিলেন রাঙামাটি সংসদীয় আসনের সাংসদ ও আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সদস্য ঊষাতন তালুকদার এমপি, এডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এমপি, সদস্য, আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, সাবেক তথ্য কমিশনার, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম এবং দৈনিক প্রথম আলোর উপ-সম্পাদক ও কলামিষ্ট সোহরাব হাসান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। ‘শান্তি বনাম অসহযোগ আন্দোলন’ শিরোনামে মূল প্রবন্ধ উপস্থধাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। সভায় সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ সাংগঠনিক সম্পাদক বিনোতাময় ধামাই। মুক্ত আলোচনায় আরো অংশ নেন, আদিবাসী নারী নেত্রী বিচিত্রা তির্কি, উন্নয়ন কর্মী সৌভাগ্য মঙ্গল চাকমা, হেডম্যান নেতা শান্তি বিজয় চাকমা, সোহেল হাজং, সুবোধ বাস্কে, মিথিলা চাকমা প্রমুখ। মূল প্রবন্ধে রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, পার্বত্য চট্ট্রগাম হচ্ছে বাঙ্গালিদের নয়া উপনিবেশবাদ। পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিরাপত্তার নামে সামরিক শাসনের মধ্যে রাখা হয়েছে। কিন্তু বস্তুত সেখানকার সমস্যা নিরাপত্তা নয়, এটি একটি রাজনৈতিক সমস্যা। রাজনৈতিকভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে সমাধান করতে হবে। প্রবন্ধে তিনি আরও বলেন, সংখ্যার রাজনীতি চলছে পার্বত্য চট্ট্রগামে। প্রতিনিয়ত আদিবাসীদের সংখ্যালঘূ করার রাজনীতি চলছে। এভাবে আদিবাসীদের সংখ্যালঘূ থেকে সংখ্যাশুন্য করতে চায় শাসকগোষ্ঠী। আমরা দেখি ইতোমধ্যে এই রাজনীতির শিকার হয়ে অনেক আদিবাসীরা দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। সন্তু লারমা তার বক্তব্যে আরও বলেন, সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়েই পার্বত্য চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত চুক্তি বাস্তবায়নতো হয়নি বরং চুক্তি বাস্তবায়নের কাজকে নানাভাবে কালক্ষেপন করা হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং জাত্যাভিমানও চুক্তি বাস্তবায়নের পথকে বাধাগ্রস্থ করছে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থাও সেভাবে গড়ে উঠেছে যার কারনে গুটি কয়েক মানুষ হয়তো এই উগ্র জাতীয়তাবাদ বা জাত্যাভিমান এর বাইরে চিন্তাভাবনা করেন। যার কারনে তাদের পক্ষেই শুধুমাত্র আদিবাসীদের পক্ষে কথা বলা সম্ভব হয়। এক সসময় সরকারকে চুক্তি করতে বাধ্য করেছি। এখন এমনই বাস্তবতা দাড়িয়েছে যে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারকে বাধ্য করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, পার্বত্যাঞ্চলের আদিবাসীরা যখন তাদের মৌলিক আধিকারের দাবি জানিয়েছে তখনই তাদের উপর নানা ধরনের হুমকি দেওয়া হয়েছে। মৌলিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রেও তাদের উপর বৈষম্য করা হয়। ঊষাতন তালুকদার এমপি বলেন, আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এরপর এ আওয়ামীলীগ সরকার তিন বারের মতো ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু তারা চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি। তিনি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সাথে অনেকবারই আলোচনা হয়েছে। সেইসব আলোচনায় তিনি অনেক আন্তরিক থাকলেও বাস্তবায়ন নেই। প্রধানমন্ত্রী চাইলে যে কোন কিছুই দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারেন। তবে কি চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নেই, এটা কি তার ক্ষমতার বাইরে? পীর ফজলুর রহমান এমপি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নে দিন দিন শুধূ বিলম্ব হতেই চলেছে, নানা ধরনের সমস্যা দিন দিন তৈরি হচ্ছে। আদিবাসীসহ অনেকেই সন্দেহ পোষন করছে আদৌ এই চুক্তি বাস্তবায়ন হবে কিনা। পাবর্ত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে যে কমিটি করা হয়েছে সেই কমিটি গত ১৭ বছরে মাত্র ৫টি বৈঠক করেছে। তাহলে এই চুক্তি কিভাবে বাস্তবায়িত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করবো। তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চুক্ত বাস্তবায়নের জন্য আর কালক্ষেপন না করে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে এবং বাধ্য করতে হবে যে একটি নির্দিস্ট সময়ের মধ্যে পার্বত্য চুক্তি বাস্তাবায়নের অঙ্গীকার করতে হবে। পর্যটন শিল্প, নানা ধরেনর উন্নয়ন কর্মকান্ডের নামে, নিরাপত্তার নামে পাহাড়ের আদিবাসীসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। শাহীন আনাম বলেন, আমরা সবসময় গর্ব করে বলি বাংলাদেশ দেশ বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক একটি দেশ। কিন্তু মুখে বললেও আমরা কিন্তু এই বৈচিত্র্যকে মর্যাদা দিতে পারি না। আমরা সবসময় আদিবাসীদের অধিকারকে খর্ব করছি। আদিবাসীদের অধিকারকে স্বীকার করতে হলে পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। তিনি আরও বলেন, আদিবাসী নারীদের ধর্ষণ, অপহরন, হত্যা করে আদিবাসীদের অনবরত অপমান করা হচ্ছে। নারীর উপর এ ধরনের সহিংসতাকে আদিবাসী উচ্ছেদের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করা হচ্ছে। সোহরাব হাসান বলেন, এখন পর্যন্ত চুক্তি যে বাস্তবায়ন হচ্ছে না এর দায় সরকার এড়াতে পারে না। রাষ্ট্র পক্ষ সবসময় বলছে চুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো কবে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হবে। ১৭ বছর পার হয়ে গেছে, আর কত বছর লাগবে? সঞ্জীব দ্রং বলেন, পার্বত্য চুক্তি হওয়ার সময় সরকারের যে আন্তরিকতা ছিল বর্তমানে সে আন্তরিকতা আমরা আর দেখছি না। এ চুক্তি বাস্তবায়িত হলে শুধূ পাহাড়ী আদিবাসী নয়, সারাদেশের আদিবাসীসহ বাঙ্গালি জনগণও উপকৃত হবে। সকল ভেদাভেদ ভুলে এই চুক্তির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন সকলের জন্যই মঙ্গল হবে।
–হিলবিডি২৫/সম্পাদনা/সিআর.