প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন,পার্বত্য শান্তিচুক্তির অধিকাংশ ধারা পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হয়েছে অথবা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যে ধারাগুলো বাস্তবায়িত হয়নি সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, পার্বত্য সমস্যাকে আমরা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছি। পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশে এধরনের সমস্যা সমাধানে অন্য কোন দেশকে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে নিয়োগ করে থাকে। কিন্তু আমরা কোন তৃতীয় পক্ষ নিয়োগ না করেই সমস্যার সমাধান করেছি। কারণ আমরা মনে করি এটি আমাদের ভূখন্ডের সমস্যা এখানকার মানুষগুলো আমাদের এবং তাদের সমস্যাও আমাদেরই, সমাধান আমাদেরকেই করতে হবে।
বুধবার সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতা ও স্বতন্ত্র সাংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদারের এক সম্পুরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তি ৪ খন্ডে বিভক্ত। ‘ক’ খন্ডে ৪টি, ‘খ’ খন্ডে ৩৫টি, ‘গ’ খন্ডে ১৪টি এবং ‘ঘ’ খন্ডে ১৯টি অর্থাৎ সর্বমোট ৭২টি ধারা রয়েছে। এর মধ্যে মোট ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত, ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আমরা এই সংঘাত নিরসনে মনোযোগ দিই। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে প্রায় সুদীর্ঘ ২২ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বয়ে চলে শান্তির সুবাতাস। এ জন্য এই চুক্তি শান্তি চুক্তি নামে সর্বাধিক পরিচিত।
তিনি বলেন, শান্তি চুক্তি বাস্তাবায়নের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সাল থেকে অদ্যাবধি ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য পরপর ৫টি ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। ভূমি সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১ পাস করা হয়েছে। এই ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১ সম্পর্কে আঞ্চলিক পরিষদ উত্থাপিত আপত্তিসমূহ বিবেচনা করে এই আইনের সংশোধনী প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আশা করা হচ্ছে এই এলাকার জনগণের ভূমির অধিকার সুরক্ষার লক্ষ্যে শিগগিরই ভূমি জরিপ করা সম্ভব হবে এবং ভূমি কমিশন কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
তিনি বলেন, শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি হিসেবে খাগড়াছড়ি জেলায় ৩০টি বিভাগ, রাঙ্গামাটি জেলায় ৩০টি এবং বান্দরবান জেলায় ২৮টি জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার যথাযথভাবে পার্বত্যবাসী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২৩টি উপজাতীয় শরণার্থী পরিবারের ৬৪ হাজার সদস্যকে ইতোমধ্যেই পুনর্বাসিত করা হয়েছে। প্রতিটি পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে। ২০ বছর পূর্বে যারা চাকরির স্থান ত্যাগ করেছিল তাদের পুনরায় চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগের শর্ত শিথিল করে তাদের নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়।
তিনি বলেন, শান্তি চুক্তির পর বিভিন্ন ধরনের ১৭৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে। সম্প্রতি রাঙামাটিতে ১টি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও রাঙামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য সমতলের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা বলবৎ রয়েছে। পার্বত্যাঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ, সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যময় জীবনধারাকে বজায় রেখে এবং স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে পার্বত্য পর্যটন শিল্প বিকাশের ধারাকে অব্যাহত রাখার সকল প্রচেষ্টা সরকার করে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে দেশী এবং বিদেশী এনজিওসমূহের কার্যক্রম, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পার্বত্যাঞ্চলে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ, ভারত ও মায়ানমারের সাথে যোগাযোগ সড়ক, অরক্ষিত সীমান্ত অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধান, অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার, পার্বত্যাঞ্চলে মোতায়নরত সেনা বাহিনীকে ছয়টি স্থায়ী সেনা নিবাসে প্রত্যাবর্তন, সামাজিক উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৩ পার্বত্য জেলায় ৪১ হাজার ৮৪৭ জনকে বয়স্ক ভাতা, ২২ হাজার ৪১০ জনকে বিধবা ভাতা, ৭ হাজার ৩১১ জনকে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা এবং ৯৮১ জন প্রতিবন্ধীকে শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আওতায় এ অঞ্চলে ১ হাজার ৪৬টি সমিতির মাধ্যমে ৫২ হাজার ১৭২ জন সদস্যের দারিদ্র্য বিমোচন তথা জীবনমান উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ৬২৩টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ২৫৭ কোটি ২১ লাখ টাকায় ৩ হাজার ৯০৬টি স্কীম বাস্তবায়ন হয়েছে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ শান্তি চুক্তির পর ৪০টি নতুন বিদ্যালয় স্থাপন এবং ১শ’টি বিদ্যালয় মেরামত/সংস্কার করা হয়েছে। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ ৩২ কোটি ৯৮ লাখ টাকায় ক্ষুদ্র যোগাযোগ অবকাঠামোসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতার নৃশংস হত্যাকান্ডের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে এক রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হয়। এই সংঘাতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ বহু লোক হতাহত হয়। হাজার হাজার উপজাতি জনগোষ্ঠী পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল এক অশান্ত জনপদ। ১৯৭৫ পরবর্তী ১৯৯৬ পর্যন্ত সরকারগুলো তাদের ভ্রান্তনীতির কারণে এবং আন্তরিকতার অভাবে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন,২০০১ সালের নির্বাচনে আমরা ক্ষমতায় আসতে পারিনি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার চুক্তির শর্তসমূহ বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখায়নি। ফলে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন স্তিমিত হয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শান্তি চুক্তির অবাস্তবায়িত ধারাসমূহ বাস্তবায়ন এবং পার্বত্য এলাকার সর্বস্তরের জনগণের উন্নয়নে নানামুখী উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।
সাংসদ ঊষাতন তালুকদারের এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট এই চুক্তি বিরোধীতা করেছিল। যেদিন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় সেদিন তিন পার্বত্য জেলায় তারা হরতাল ডেকেছিল, যাতে চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব না হয়। বিএনপি নেত্রী তখন বলেছিল এই চুক্তি স্বাক্ষর হলে ফেনী পর্যন্ত দেশ ভারতের দখলে চলে যাবে।