প্রায় একযুগ ধরে খাগড়াছড়ির পরিবহন সেক্টরের সবচেয়ে বড়ো প্রতিষ্ঠান ‘খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপ’-এ চলছে অগণতান্ত্রিকভাবে নেতৃত্বে থাকা ‘সম্বন্ধী-দুলাভাই’-এর দ্বৈত স্বেচ্ছাচারিতা। আর্থিক ব্যবস্থাপনাতেও চরম অনিয়মের অভিযোগ আছে।
১৯৯০ সালে ‘খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি’ গঠন করা হয়। ২০০৪ সালে ‘খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপ’ নামে যাত্রা করে, যা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধনভুক্ত। এত দিন নির্বাচন না হলেও হাত তুলে বা কণ্ঠভোটে সভাপতি/সম্পাদক নির্বাচন করা হতো। ২০০৯ সালে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মাহবুব সভাপতি হওয়ার পর থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।
সর্বশেষ গত বছরের ২ নভেম্বর (২০১৯ ইংরেজি) খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপ এর সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সভায় বানিজ্য সংগঠন আইন ১৪ (১) অমান্য করে নির্বাচন ছাড়াই কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত বৈঠকে উপস্থিত তিন মালিক সদস্যের প্রস্তাবনায় সভাপতি হন মাহবুবুল আলম এবং সা: সম্পাদক হন খলিলুর রহমান খোকন। দুইজন একে অপরের দুলাভাই আর সম্বন্ধী। এছাড়া মোঃ হানিফকে কার্যকরী সদস্য করা হয়। অথচ সেই বৈঠকে কমিটি গঠনের কোনই এজেন্ডা ছিলনা। সভায় উপস্থিত তিন মালিক সদস্যের মোঃ হোসেন, মোঃ রোকন উদ্দিন ও মোঃ নুর হোসেন জানান, আমরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম ঠিকই। তবে আমরা গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচনের কথা বলেছি। ১১ বছর ধরে যারা অবৈধ উপায়ে ক্ষমতা দখল করে রেখেছে সংগঠনের টাকা লুটপাট করছে তাদের প্রস্তাব কিংবা সমর্থন দেয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। তারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতায় গেছে। এবং ক্ষমতায় যাওয়ার এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো কমিটির অনুমোদন পায়নি।
এই তিন মালিক সদস্য কার্যকরী কমিটির কোন পদে প্রস্তাব বা সমর্থন দেননি বলেও দাবি করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংগঠনটির ১৪৪ জন্য মালিক সদস্যের অধিকাংশ ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের প্রতি অসন্তুষ্টি জানিয়েছে। তারা সংগঠনের সভাপতি-সম্পাদকের কাছে লিখিত আবেদন করে সাধারণ নির্বাচন দেয়ার দাবি জানান। আবেদনে তারা সভাপতি সম্পাদককে উদ্দেশ্যে করে বলেন, ছল চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে একই ব্যক্তি দিয়ে বার বার কমিটি গঠন করায় মালিকদের ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। তারা অবিলম্বে সাধারণ নির্বাচনের দাবী জানান।
সংগঠনের বর্তমান সভাপতি মাহবুব উল আলম একদশক যাবত পরিবহন খাতের তিনটি সংগঠন থেকে তিনটি পদে থেকে মাসিক সম্মানী ৪৮ হাজার টাকা। তিনি শ্রম আইন ও ট্রেড ইউনিয়নের শর্ত লঙ্ঘন করে একই সাথে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
মালিক গ্রুপের সদস্য এবং খাগড়াছড়ি জেলা শ্রমিক দলের সা: সম্পাদক মো: রোকন উদ্দিন অভিযোগ করেন, নিজের গাড়ি না থাকা সত্ত্বেও ২০০৯ সালে প্রভাব খাটিয়ে মালিক গ্রুপের সদস্য হন মাহবুব। এর পর বাণিজ্য সংগঠন আইন অমান্য করে নির্বাচন ছাড়াই গায়ের জোরে সংগঠনের সভাপতি বনে যান। আর তাঁর আপন সম্বন্ধী খলিলুর রহমান প্রকাশ খোকন ড্রাইভারকে করা হয় মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক। গঠনতান্ত্রিক বৈধভাবে নির্বাচনসহ অন্যান্য নিয়ম অনুসৃত না হওয়ায় কোনো জবাবদিহি নেই।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, লাইন খরচের নামে প্রতি মাসে আয় হওয়া প্রায় ১৭ লাখ টাকার কোনো হদিস নেই।
সংগঠনের ১৪৪ সদস্যের বেশিরভাগ কমিটির ওপর অনাস্থা দিলেও তা কাজে আসেনি। সর্বশেষ একতরফা নির্বাচনের প্রতিবাদকারী সদস্য আব্দুল লতিফ হাইকোর্টে রিট করেন। আদালত তিন সপ্তাহের মধ্যে জবাব দিতে বললেও কেউ জবাব দেননি। এদিকে প্রতিবাদ করায় আব্দুল লতিফের দুটি গাড়ি সমিতির রোটেশন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে এক বছর ধরে দুটি বাস চলাচল করতে পারছে না।
সংগঠনের সদস্য মোঃ আবদুল লতিফ বলেন, বৈধ নির্বাচন না হওয়ায় মালিক গ্রুপের কোন স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নেই। লাইন খরচের নামে প্রতি মাসে আয় হওয়া লাখ লাখ টাকার কোন হদিস নেই। প্রতিবাদ করায় রোটেশন থেকে আমার দুটি গাড়ী বাদ দিয়েছে। ফলে আজ প্রায় এক বছর ধরে দুটি বাস চলাচল করতে পারছেনা। গুটি কয়েক লোক পুরো সংগঠনটা জিম্মি করে রেখেছে।
মালিক গ্রুপের আরেক সদস্য ও খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের সা: সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায় দাশ অভিযোগ করেন, বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা ১৪ (১) ধারা অনুযায়ী, পরিচালনা কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগে তিন সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচনী বোর্ড ও তিন সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচনী আপিল বোর্ড গঠন করতে হয়। তা না করে সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২ নভেম্বর কমিটি গঠিত হয়েছিল। তফসিল ঘোষণা ছাড়াই সেখানে আলম পরিবারের চার সদস্য মিলে জোর করে কার্যনির্বাহী কমিটি ঘোষণা করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে মেয়র রফিকুল অন্যায়ভাবে বড় ভাইকে সভাপতি ও খলিলুরকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করেন। এ নিয়ে সংগঠনের ১৪৪ সদস্যের মধ্যে ৯০ জন আপত্তি জানান। তাঁরা একতরফা কমিটি বাতিল করে নির্বাচন দেওয়ার দাবি তোলেন।
গেল ৩১ অক্টোবর সমিতির উপদেষ্টাদের নিয়ে মালিক গ্রুপের একটি অংশ শহরের একটি রেস্টুরেন্টে বৈঠক করেন। বৈঠকে সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের উপদেষ্টা রণ বিক্রম ত্রিপুরা ও নির্মলেন্দু চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। এসময় যানবাহন মালিকরা বর্তমান কমিটি এবং সংগঠনটির অনিয়মগুলো তুলে ধরেন।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমান খোকন বলেন, আমরা বিধি মোতাবেক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছি। অবৈধ উপায়ে আসিনি। এখন যারা আল্টিমেটাম দিচ্ছে বা গাড়ী বন্ধের হুমকি দিচ্ছে এমন পরিস্থিতি যদি তৈরি হয় নিশ্চই আমরা বসে থাকবো না।
সংগঠনটির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, এত বড় সংগঠনে অবৈধভাবে পদে বসার কোন সুযোগ নেই। সাধারণ সদস্যরা চেয়েছে বলে আমরা পদে বসেছি। এই নিয়ে হাই কোর্টে রীট দায়ের করা হয়েছে। এখন আদালত যদি আমাদের বৈধ বলে তাহলে কোন তাহলে নতুন করে কিছু করার নেই। আর যদি অবৈধ বলে তাহলে দ্রুত সাধারণ সভা করে নির্বাচন দিয়ে দিব। শ্রমিক নেতা হয়েও মালিক নেতা হওয়া যাবে না, এমন কিছু বিধানে নেই।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.