২০২৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০০টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২১ জনকে হত্যা, ৬ হাজার ৫৫ জন পাহাড়ী লোকজন মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার,১১৯টি বাড়ি ও দোকান অগ্নিসংযোগ,লুটপাট করা হয়েছে। এছাড়াও ২ হাজার ৩১৪ একর ভূমি বেদখল করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রæপ, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, সেটেলার ও ভূমিদস্যুদের দ্বারা এসব মানবধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।
বুধবার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমার পাঠানো বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের নাজুক সামগ্রিক পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরংশ সার্বিক পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি। উপরন্তু পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও পাহাড়ী স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম অধিকতর জোরদার হয়েছে। ২০২৪ সালে সবচেয়ে নৃশংস ও লোমহর্ষক ঘটনা হলো সেপ্টেম্বরে জুম্ম(পাহাড়ী) জনগণের উপর নৃশংস সাম্প্রদায়িক হামলা, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হওয়া এবং ডিসেম্বরে লামায় ত্রিপুরাদের ১৭টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ড.মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে না হতেই এ নৃশংস সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়। পূর্বের সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর মতো উক্ত সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের কাউকেই আইনের আওতায় আনা হয়নি ও উক্ত ঘটনার যথাযথ বিচার নিশ্চিত হয়নি।
১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পৃষ্টপোষকতায় সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের সাম্প্রদায়িক হামলাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে ২১টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা এবং সে লক্ষ্যে জুম্মদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা, পাহাড়ীদের ভূমি জবরদখল করা, তাদের চিরায়ত জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ করা। পূর্বের সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর মতো উক্ত সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের কাউকেই আইনের আওতায় আনা হয়নি।
গেল বছরে মুসলিম সেটেলার কর্তৃক জুম্ম নারী ও শিশুর উপর ১২টি সহিংসতার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ১৬ জন পাহাড়ী নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। এসব ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও পুলিশেন দুর্বল অভিযোগ গঠন ও ভূমিকার কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা গ্রেপ্তারের কয়েক দিন পরে জামিনে জেল থেকে বের হয়ে যায়। ফলে এ যাবৎ পাহাড়ী নারী ও শিশুর উপর সংঘটিত কোনো ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়নি। এ বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে পাহাড়ী নারী ও কন্যাশিশুর উপর অব্যাহতভাবে লোমহর্ষক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গেল বছর ১৮ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদর ও রাঙামাটি সদরে এবং ১ অক্টোবর খাগড়াছড়ি সদরে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের উপর অন্যতম সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর ছত্রছায়ায় মুসলিম সেটেলার কর্তৃক সংঘটিত এসব হামলায় ধন রঞ্জন চাকমা, জুনান চাকমা, রুবেল ত্রিপুরা ও অনিক কুমার চাকমাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এবং শতাধিক পাহাড়ী আহত হয়। এছাড়া পাহাড়ীদের শতাধিক ঘরবাড়ি, বৌদ্ধ মন্দির দোকান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে হামলা চালিয়ে ১০টি গাড়ি ভস্মীভূত ও অফিসের গ্রাউন্ড ফ্লোর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে তথাকথিত বৈষম্য বিরোধী বাঙালি ছাত্র আন্দোলন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের ব্যানারে মুসলিম সেটেলার এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে লেলিয়ে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা জোরদার করা হয়েছে। বান্দরবানের থানচি থেকে আটককৃত ইসলামী জঙ্গী সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র ৯ জন সদস্যকে গত নভেম্বরে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে দাবী করা হয়, ২০২৪ সালে শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা ১১৯টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এতে কমপক্ষে ৫ হাজার জন বমসহ ৫ হাজার ৬৫৫ জন, প্রায় এক হাজার পরিবারসহ ১ হাজার ৩২১ পরিবার ও ৪৭টি বম গ্রামসহ ৯৪টি গ্রামের লোক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ১৬ জন বমসহ ২০ জনকে, গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলায় জড়িত করা হয়েছে ১৪৩ জনকে, সাময়িক আটক করা হয়েছে ২৮ জনকে, জুম ও বাগান-বাগিচা চাষে বাঁধা ও ক্ষতি করা হয়েছে ৪২ পরিবারকে, সীমান্ত সংযোগ সড়কে ক্ষতি করা হয়েছে ২৪২ পরিবারকে এবং পারিবারিক তথ্য ও ছবি প্রদানে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ২০টি গ্রামকে।
এছাড়া ২০২৪ সালে সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলগুলোর মধ্যে মগ পার্টি, বম পার্টি ও ইউপিডিএফ (প্রসিত) দ্বারা ৪৪টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ১৭৪ জন ও ৩৬টি গ্রামের অধিবাসী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার মধ্যে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, মারধর, হত্যা, গুলিতে আহত, তল্লাসী, হত্যার হুমকি, গবাদিপশু ও মুরগী ছিনতাই, টাকা ও মোবাইল ছিনতাই, চাঁদা দাবি ইত্যাদি ঘটনা ছিল।
তাছাড়াও গেল জুলাই মাসে রাঙামাটি শহরে ইউপিডিএফ (প্রসিত) সশস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৮ জন আহত ও ২ জন ছাত্রীকে অপহরণ করা হয়। ইউপিডিএফ কর্তৃক ৪ জন ত্রিপুরা গ্রামবাসীকে হুমকি ও বেদম মারধর করা হয়। পানছড়ি উপজেলার লোগাং ইউনিয়নের হাতিমারা গ্রামে একটি বিয়ে অনুষ্ঠানে ইউপিডিএফ হঠাৎ হানা দিয়ে ৩ নিরীহ জুম্মকে অপহরণ, ৬ থেকে ৭ ব্যক্তিকে বেদম মারধর এবং ৫০ থেকে ৬০ জনের মোবাইল ফোন ছিনতাই করা হয়।
পার্বত্য চুক্তির স্বাক্ষরের পর ২৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান তো অর্জিত হয়ইনি, বরঞ্চ রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক পাহাড়ী জনগণের উপর বৈষম্য ও বঞ্চনার স্টিমরোলার অধিকতর জোরদার হয়েছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে ব্যাপক সামরিকায়ণ করে ফ্যাসীবাদী কায়দায় দমন-পীড়নের মাধ্যমে সমাধানের নীতি বলবৎ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে দাবী করা হয়েছে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.