পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা বর্তমান বাস্তবতায় পাহাড়ের বুকে একটা অনিশ্চিত জীবন ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে বিশেষ শাসনে শাসিত হয়ে আসছি। যে শাসন ব্যবস্থা আমাদের পীড়া দেয়, আমাদেরকে ব্যাধিত করে, জীবনকে সংকোচিত ও ভবিষ্যতকে বিপর্যস্ত করেছে। স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা. অধিকার নিয়ে, আত্মতৃপ্তি নিয়ে বেঁচে থাকার অনুপস্থিত রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে সমাধানের জন্য পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেই চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য পাহাড়ের প্রতিটি নর-নারীকে এগিয়ে আসতে হবে। চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় আমাদের সীমাবদ্ধ জীবন নিয়ে কাটানে হচ্ছে। তবে এ সীমাবদ্ধতা জীবন সুখকর হতে পারে না। সেই সীমাবদ্ধতা জীবন অত্যান্ত কষ্টকর ও শাসরুদ্ধকর।
শুক্রবার সকালে পাহাড়ে শান্তি নিকেতন হিসেবে পরিচিত ও শিক্ষা প্রসারের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান মোনঘরের ৫০ বছর পূর্তি(সুবর্ণ জয়ন্তী) উৎসবের দুদিন ব্যাপী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সন্তু লারমা এসব কথা বলেন।
মোনঘর মাঠে সূবর্ণ জয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় মোনঘর পরিচালনা পর্যদের সহ-সভাপতি গৈরিকা চাকমার সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার রাজা দেবাশীষ রায়, মং সার্কেল চীফ সাচিং প্রু চৌধুরী,মোনঘর পরিচালনা পর্যদের সভাপতি শ্রদ্ধালংকার মহাথের, ফান্সের দাতা পিয়ারে মারচেন্ট, মোনঘর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সুভাষ চাকমার সহধর্মীনি রাখী দেওয়ান। স্বাগত বক্তব্যে দেন দি মোনঘোরিয়ান্সের সভাপতি শ্যামল মিত্র চাকমা। অনুষ্ঠানে শুরুতে জাতীয় সংগীত ও মোনঘরের প্রাতঃ প্রার্থনা সংগীত আমা জাগা আমার ঘর আমা বেগ মোনঘর গানের পরিবেশনা করা হয়। এছাড়া অনুষ্ঠানে মোনঘরের সূবর্ণ জয়ন্তী উৎসবের স্মারকগ্রন্থ উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে অবদানের জন্য সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, সুবিমল চাকমা ও ব্প্লিব চাকমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এর আগে রাঙ্গাপানি মাঠে ভেলুন ও পায়না উড়িয়ে সূবর্ণ জয়ন্তীর উদ্বোধন করেন সন্তু লারমা। পরে একটি বর্নাঢ্য র্যালী বের করা হয় ও মোনঘর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মুর্যাল উদ্বোধন করা হয়। এই সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবে গেল পাঁচ দশকের স্মৃতি ফেরে নব-প্রবীনদের যেনো মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। এতে প্রায় নবীন-প্রবীন শিক্ষার্থীসহ প্রায় চার হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা করে যাওয়া শিক্ষার্থীরা তাদের সহপাঠী ও বন্ধু-বান্ধবদের পেয়ে স্মৃতি মন্থনে মেতে উঠেছেন। অনেকে আবার স্মৃতি ধরে রাখতে ক্যামরার ফ্রেমেও বন্ধি করে রাখছেন। এছাড়া দুদিনব্যপী সূবর্ণজয়ন্তী উৎসবের স্মৃতিচারণ ছাড়াও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সন্তু লারমা আরো বলেন, মোনঘর শুধু রাঙামাটি তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ নয় সারা পৃথিবী জয় করে সবাইয়ের দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে এগিয়ে যাচ্ছে। মোণঘর শিক্ষা অঙ্গনে অনেক অবদান রয়েছে। পার্বত্যাঞ্চলে পিছিয়ে পড়া যে সমাজ জীবন সেই সমাজ জীবনকে উন্নত করার জন্য সারা বিশ্বের একটা যোগসূত্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মোনঘরের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, মোনঘর আজ ৫০ বছর সফলভাবে পার হতে পেরেছে। বিশেষ করে শিক্ষায় অবহেলিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের গরীব প্রান্তিক ও আত্নসামাজিকভাবে বঞ্চিত হাজার হাজার ছেলে-মেয়েরা পড়তে পেরেছে তা একটা বড় বিষয়। মোনঘরের সাথে যে আত্নিক সর্ম্পক রয়েছে তা অব্যাহত থাকবে ।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নাট্যকার মামুনুর রশীদ, শিক্ষাবিদ শামসুদ্দীন শিশির, মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা প্রমুখ। এছাড়া দুদিনব্যপী সূবর্ণজয়ন্তী উৎসবের স্মৃতিচারণ ছাড়াও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালে রাঙামাটি শহরের অদুরে রাঙ্গাপানি এলাকায় চার একর জমিতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী জ্ঞানশ্রী মহাস্থবিরের কয়েকজন শিয্য বিমল তিয্যে ভিক্ষু, প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু ও শ্রদ্ধালংকার ভিক্ষুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেন মোনঘর শিশু সদন। মোনঘর” শব্দের অর্থ পাহাড়ে জুম চাষের জন্য চাষীদের থাকার অস্থায়ী আশ্রয়স্থল। যতদিন পর্ষন্ত চাষীরা জুমের ধানের বীজ থেকে অন্যান্য ফলন মোনঘরে তূলতে না পারে ততক্ষন পর্ষন্ত এই আশ্রয়স্থলে থেকে কাজকর্ম চালিয়ে যায় জুমিয়ারা। ঠিক তেমনি পাহাড়ের ১৩টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্বা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা,তঞ্চঙ্গ্যা, চাক, বম, লুসাই, পাংখোয়াসহ অসহায় ছিন্নমূল অনাথ, গরীব ও মেধাবী ছেলে-মেয়েদের মোনঘরে আশ্রয় দিয়ে শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা হয় । ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি পাহাড়ে অন্যতম শিক্ষার পিঠ স্থানে হিসেবে পরিণত হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে গেল পাঁচ দশকে কয়েক হাজার পাহাড়ী সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন ।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.