• Hillbd newsletter page
  • Hillbd rss page
  • Hillbd twitter page
  • Hillbd facebook page
সর্বশেষ
খাগড়াছড়ির অনন্য এক প্রাথমিক শিক্ষক রুপা মল্লিক,যাঁর পথচলার বাঁকে বাঁকে শ্রম আর সাফল্য                    পরবর্তী বাংলাদেশের এনসিপি নেতৃত্বে দেবে-হাসনাত আবদুল্লাহ                    রাঙামাটিতে তিন দিনের সাবাংগী মেলার উদ্বোধন                    চট্টগ্রাম আঞ্চলিক তথ্য অফিসের গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে মতবিনিময় সভা                    বিলাইছড়িতে যুবদলের ৪৭ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন                    কাপ্তাই হ্রদে মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে এক যুবকের মৃত্যু                    কাউখালী বেতবুিনিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত                    রাঙামাটি রাজ বন বিহারে দুদিনের কঠিন চীবর দানোৎসব সম্পন্ন                    রাঙামাটির রাজবন বিহারে দুই দিনব্যাপী কঠিন চীবর দান উৎসব শুরু                    বৃহস্পতিবার থেকে দুদিন ব্যাপী শুরু হচ্ছে রাজ বনবিহারে ৪৯তম কঠিন চীবর দান                    রাঙামাটির সীমান্তবর্তী দুর্গম হরিণায় বিজিবির মানবিক সহায়তা                    বিলাইছড়িতে প্রকল্প পরিদর্শনে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক                    বিলাইছড়িতে বিভিন্ন বিদ্যালয় পরিদর্শনে ডিপিও                    বিলাইছড়িতে ২২ লিটার মদসহ আটক ১                    কাপ্তাই হ্রদ খননে পরিকল্পনা নেওয়া হবে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ উপদেষ্টা                    রাঙামাটির বিএফডিসির বেহাল অবস্থায় দেখে হতাশা প্রকাশ মৎস্য উপদেষ্টার                    জুরাছড়ির ধামাইপাড়া বৌদ্ধ বিহারে কঠিন চীবর দান সম্পন্ন                    কাউখালীতে পাহাড় কাটতে গিয়ে মাটি চাপায় নিহত ১: আহত ১                    ইইউ’র অর্থায়নে বিলাইছড়িতে নগদ অর্থ সহায়তা পেল ১৭৯ পরিবার                    ৮৬ দিন পর ভেসে উঠল রাঙামাটির পর্যটনের ঝুলন্ত সেতু                    রাঙামাটিতে প্রধান শিক্ষককের বিদায় সংবর্ধনা ও শিক্ষক সম্মাননা প্রদান                    
 
ads

আমার বন্ধু কালায়ন চাকমা/বিপ্লব রহমান

ডেক্স রিপোর্ট : হিলবিডি টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 04 Oct 2014   Saturday

প্রথম যৌবন বেলায় রাঙামাটির নান্যাচরের মাওরুম গ্রামে গিয়েছি সমীরণ চাকমার বিয়েতে। সমীরণ দা পরে শান্তি চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ’র সঙ্গে যুক্ত হন। সেই গ্রুপ ছেড়েছেন, সে-ও অনেকদিন আগের কথা। এর আগেও বহুবার চাকমাদের বিয়ের নিমন্ত্রণে গিয়েছি। কিন্তু ১৯৯৩ সালের শেষের দিকে, সমীরণ দা’র ওই বিয়েটি ছিলো খুবই জাঁক-জমকপূর্ণ। একদম আদি চাকমা সংস্কৃতির কোনো বিয়েতে অংশগ্রহণ সেই প্রথম। কয়েকটি গ্রামের নানা বয়সী নারী-পুরুষ এসেছে সেই বিয়ের নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে। বলতে দ্বিধা নেই, ঢাকা থেকে নিমন্ত্রিত তো বটেই, এমন কি পুরো বিয়ের অনুষ্ঠানে একমাত্র বাঙালি অতিথি আমি একাই। বরের বাড়িটিকে সাজানো হয়েছে রঙিন কাগজ, ফুল, লতা-পাতায়। পাশের মাঠে নিমন্ত্রিতদের বসার জন্য টাঙানো হয়েছে বিশাল সামিয়ানা। সেখানে পাতা হয়েছে সারি সারি মাদুর। এক দল ছেলেমেয়ে গিটার বাজিয়ে মাইকে গান করে চলেছে অবিরাম। আমার পাহাড়ি বন্ধুরা জানান, এই গ্রামটি হচ্ছে ‘নতুন মাওরুম’। অবশ্য আনুষ্ঠানিক বাংলায় এর নাম ‘মহাপ্রুরম’। আর নান্যাচর থানাটি কাগজ-পত্রে ষোলআনা বাঙালিয়ানায় হয়েছে ‘নানিয়ারচর’। তো আদি মাওরুম গ্রামটি এখন কাপ্তাই বাঁধের ফলে জলের তলায়। সেখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন জুম্ম (পাহাড়ি) জাতির মহান নেতা এমএন লারমা। নয়া মাওরুম গ্রামের একটি ছোট্ট এক চালা বেড়ার ঘরের প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখিয়ে আরেক জন বন্ধু কল্পনার জের টেনে বলেন, এমএন লারমার সেই বিলুপ্ত গ্রামটিতেও হয়তো একই রকম স্কুল ছিল। যেখানে তিনি পড়াশুনা করেছিলেন। আবার বড় হয়ে ওই স্কুলেই শিক্ষকতা করেছেন।… এরই মাঝে বিয়ের কনে চলে আসে। কনেটি ঐতিহ্যবাহী পিনন-খাদি (লুঙ্গি-ওড়না), সোনার গহনায় মোড়া একদম পরীর মতো। বরের বাড়িতে ঢুকতে হলে তাকে আবার ছোট্ট একটি পরীক্ষা দিতে হবে। প্রধান ফটকের দুপাশে পোঁতা হয়েছে দুটি কলাগাছ। গাছ দুটির দুপাশে রাখা হয়েছে জলভর্তি মাটির কলস। আর কলস দুটির দুমুখে সাদা সুতো বেধে তৈরি করা হয়েছে একটি ব্যারিকেড। চাকমা রীতি হচ্ছে, কন্যাকে এক লাফে এই সুতো পেরিয়ে কলা-গেট দিয়ে প্রবেশ করতে হবে ছেলের বাড়িতে। তো মেয়েটি গ্রামের হলেও বেশ চটপটে। ওই জবর-জং সাজ-পোশাকসহ, পিননটি একটু উঁচু করে ধরে একলাফে পেরিয়ে যায় পুলসেরাত। চারিদিকে তুমুল উল্লাস ধ্বনী উঠে। সামিয়ানায় মাদুর পেতে বসা অতিথিদের জন্য সেচ্ছা-সেবকরা দেন পান-সুপারি-সিগারেট। আসে ‘চোয়ানি’ নামক কড়া স্বাদের মদের বোতল, ছোট্ট ছোট্ট কাঁচের গ্লাস। এরপর একটি আশির্বাদের ট্রে ঘুরতে থাকে। সেখানে যার যেমন সামর্থ সে অনুযায়ী নগদ টাকা উপহার দেন। এরই মধ্যে বরপক্ষের লোকজন বিয়ে উপলক্ষে কাটা শুকরের মাথা কলাপাতায় মুড়ে এসে অতিথিদের দেখান। অর্থাৎ মান্যবরগণ, দেখুন, আমরা কিন্তু সব চাকমা সংস্কৃতি-রীতি-নীতি মেনে এই বিয়ের আয়োজন করেছি, ইত্যাদি। বলা ভাল, বিয়ের আসরে প্রবীনদের পাত পড়েছে একদিকে। আর নবীনরা বসেছে অন্যদিকে। আমি যেন, বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান সব ভাল করে দেখতে পাই, এ জন্য আমার বন্ধুরা আমাকে বসিয়েছে সামিয়ানার সামনের সারিতে, ওই বয়স্কদের মাঝেই। আমি চোয়নি খেতে খেতে মঞ্চের দিকে তাকাই। কয়েকজন ভান্তে (বৌদ্ধ পুরহিত) মন্ত্র পাঠ করে বিয়ে পড়ান। মাইকে আবারও বাজতে থাকে আধুনিক চাকমা গান। এরই মধ্যে ছেদ ঘটান হাড্ডিসার কালো মতো এক পাহাড়ি ছেলে। তার গলায় গামছা বাধা একটি সিঙ্গেল রিডের হারমোনিয়াম। নাম শুনতে পাই ‘কালায়ন চাকমা’। এক সময় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) করেছেন। এখন গান-বাজনা নিয়েই আছেন। কালায়ন দা মাইক টেনে নিয়ে বলেন, আজ এই আনন্দের দিনে অনেক আনন্দ সঙ্গীত তো হলো। এবার একটি অন্যরকম গান হোক। আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা নিয়ে গান লিখেছি, তারই একটি আপনাদের শোনাতে চাই। এরপর তিনি বাংলা গানে শোনান রোমহর্ষক নান্যাচর গণহত্যার কথা। তার গানের প্রথম কলিটি এরকম:

১৭ তারিখ নভেম্বর/ ৯৩ ইংরেজী…

ওই তারিখেই নান্যাচর বাজারে পাহাড়িদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে হামলা চালায় সেটেলার বাঙালিরা। খুব ঠাণ্ডা মাথায় দা দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয় অন্তত ২৯ জন পাহাড়িকে। সেনা সমর্থিত ওই হত্যাযজ্ঞে আহত হয়েছিলেন আরো অনেকে। ধর্ষিত হতে হয়েছে কয়েকজন পাহাড়ি নারীকে। …কালায়ন দা গানে গানে বর্ণনা করেন গণহত্যার কথা। মনে করিয়ে দেন লংগদু, লোগাং, বরকলসহ আরো
অনেক হত্যাযজ্ঞ, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ এবং জুম্ম নিধনের কথা।… পুরো বিয়ের অনুষ্ঠানটি যেন একটি গানেই পরিনত হয় শোক সভায়। শত শত নিমন্ত্রিত অতিথি শব্দহীন কান্নায় আকুল হন। বার বার গামছায় চোখ মোছেন তারা। কেউ কেউ বুক ফাটা আর্তনাদ চাপা দিতে মুখ চেপে ধরেন গামছায়, কি খাদির আঁচলে। আমি আর থাকতে না পেরে সামিয়ানা ছেড়ে উঠে পড়ি। বিয়ের অনুষ্ঠানের বাইরে, মাঠ পেরিয়ে একটু দূরে এক কাঁঠাল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাই। দূর মাইকে তখনো ভেসে আসে কালায়ন দা’র গানের বোল:

১৭ তারিখ নভেম্বর/ ৯৩ ইংরেজী…

খানিক পরে আমাকে খুঁজতে বের হওয়া পাহাড়ি বন্ধুরা দেখা পায় আমার। তারা বলেন, খাবার দেওয়া শুরু হয়েছে। এখনই খেয়ে নেওয়া ভাল। এই খাবার-দাবারটিও আদি চাকমা বিয়ের রীতি মেনে করা হচ্ছে। আবার সামিয়ানার নীচে মাদুর পেতে বাবু হয়ে বসি। টুকরো কলাপাতায় আতপ চালের ভাত, কয়েক রকম পাহাড়ি সব্জি, মাছ, শুকর ও মুরগীর মাংস পরিবেশন করা হয়। সবশেষে দই-মিষ্টি। …আমি অনেকটা খাবার ছড়াই। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত হলেও ভাল করে কিছুই খেতে পারি না। পরে সামিয়ানার বাইরে এসে একটি ঝোপের পাশে বসে হরহর করে সব খাবার বমি করে দেই। অদেখা নান্যাচর গণহত্যা, আর ঠিক আগের বছর একদম ভেতর থেকে দেখা লোগাং গণহত্যার ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্ত যেন আমার পোষাক-আশাকে, চোখে-মুখে লেগেছে বলে ভ্রম হয়। এমনকি আমি খানিকটা জুম্ম রক্তের ঘ্রাণও যেন পাই।

কালায়ন দা, তুমি কি নিষ্ঠুর গো!…

*** লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক ***( প্রকাশিত লেখাটি সম্পুর্ন লেখকের নিজস্ব মতামত বা বক্তব্য***

সংশ্লিষ্ট খবর:
ads
ads
আর্কাইভ