হঠাৎ করেই বুধবার মধ্যরাতে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চির বিদায় নিলেন মোখলেছ-উর-রাহমান ভূঁইয়া (ইন্নালিল্লাহি---- রাজেউন) । তিনি ছিলেন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন প্রবীন সাংবাদিক, কবি, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠক সর্বপরি একজন মুক্ত চিন্তার উদার মন মানসিকতা সম্পন্ন একজন বিশিষ্ট্য ব্যক্তি । ছিলেন একজন স্পস্টবাদী আর মনে প্রানে একজন নিবেদিত সাংবাদিক । বর্তমান সমাজে যেখানে সাংবাদিকতায় এসে অনেকে বিত্ত বৈভবের মালিক হলেও এই সাংবাদিকতার পিছনেই নিজস্ব সকল বিত্ত বৈভব বিসর্জন দিয়ে অনেকটা নিঃস্ব অবস্থায় পরপারে পাড়ি জমালেন তিনি। তাঁর এই অকাল এবং অকস্মাৎ মৃত্যুতে আমরা তথা সাংবাদিক সমাজ গভীর ভাবে শোকাহত ।
৮০ এর দশকে আমি যখন রাঙামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র তখন থেকেই চিনতাম প্রয়াত মোখলেছ আংকেলকে। পারিবারিক সূত্রেও তিনি ছিলেন আমার পরিবারের একজন সুহৃদ । সেই মোখলেছ আংকেলকে যেভাবে দেখে ছিলাম আজ ৯ জুলাই রাঙামাটি প্রেসক্লাবের সামনে তাঁর নামাযে জানাযা শেষে সাদা কাফনের কাপড়ের সুখ সরিয়ে ভোবে দেখলাম মনে হলো এখন ও অবিকল সেই আগের দেখা মোখলেছ আংকেল। শুধু পার্থক্য এটুকু আগে যতবার দেেেখছি ততবার আংকেল বলে ¯েœহ ভরা কণ্ঠে যেভাবে ডাকতেন আ তিনি আর সেই ভাবে ডাকেননি । তবে নিজের মনের অজান্তেই আমি তাঁকে ডেকেছি মোখলেছ আংকেল হিসেবে। যানি এই ডাক তিনি আর কখনো শুনবেন না। তিনি যে এখন সকল কিছুর উেের্ধ্ব । সকল আলোচনা, সমালোচনার উর্ধ্বে তিনি।
স্কুল জীবনে ছাত্র অবস্থায় মোখলেছ আংকেলকে দেখেছি সাংবাদিকতার পাশাপাশি একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে । সুনীল বাবু, শাহরিয়ার রুমি ভাই, মঈণ উদ্দিন ভূইয়া,অধ্যাপক নন্দ নাল শর্মা স্যারের পাশাপাশি সকল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে মোখলেছ আংকেল ছিলেন একজন মুক্তমনের সাংস্কৃতিক সংগঠক । সেই সময় রাঙামাটি পাঠাগার কেন্দ্রিক যে সব সাংস্কৃতিক আয়োজন ছিল তিনি ছিলেন সেসব আয়াজনের ন্যতম একজন সংগঠক । নব্ব্ই এর দশকের শুরুতে যখন রাঙামাটি শহরের পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সংলগ্ন তৎকালীন বিডিআর সেক্টরের রেখে যাওয়া জায়গায় রাঙামাটি প্রেসক্লাব নতুনভাবে যাত্রা শুরু করলো সেই সময়ও তাঁকে দেখেছি বর্তমান প্রেস ক্লাবের সেই সময়কার টিনশেডের ক্লাবে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে ।
নব্বই এর দশকে যখন সাংবাদিকতায় যাত্রা শুরু করি তখন সম্ভবত ১৯৯২ সালের দিকে মোখলেছ আংকেল ছিলেন রাঙামাটি প্রেস ক্লাবের সধোরন সম্পাদক । মূলত তাঁর তাতেই রাঙামাটি প্রেস ক্লাবের সদস্য পদ আমাদের কয়েকজনার। নতুন উদ্যমে যখন রাঙামাটি প্রেস ক্লাব যাত্রা শুরু করলো সেই ১৯৯৩ কি ১৯৯৪ সালের দিকে তখন প্রেস ক্লাবের প্রথম নির্বাচনে তিনি সাধারন সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। যদিওবা আমরা তাঁর হাত ধরে প্রেস ক্লাবে এসেছিলাম তবে পরবর্তীতে বিভিন্ন কারনে তাঁকে প্রেসক্লাব থেকে দূরে সরে যেতে হয়েছিল। যদিও ২০১৫ সালের প্রেস ক্লাবের বার্ষিক সাধারন সভায় তাঁকে আবারো প্রেস ক্লাবে অর্ন্তভূক্তির কাজ শুরু হয়েছিল তবে সেই কাজ ৯ জুলাই থেকে বন্ধ হয়ে গেল।
বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে যে সব প্রবীন সাংবাদিকদের কারনে সাংবাদিকতার আজ এত প্রসার সেই সব প্রবীন সাংবাদিকদের মধ্যে মোখলেছ-উর-রাহমান ভূইয়া ছিলেন অন্যতম। রাঙামাটি থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক রাঙামাটি যা বর্তমানে দৈনিকে পরিনত হয়েছে সেই রাঙামাটি পত্রিকার হাত ধরেই এখানে অনেক সাংবাদিকের সাংবাদিকতা জীবনের সূচনা হয়েছিল। তবে যেই পত্রিকার জন্য তিনি তাঁর সর্বস্ব সহায় সম্মতি ত্যাগ করেছিলেন সেই পত্রিকার মালিকানা তিনি ধরে রাখতে পারেননি । জীবনের বাস্তবতার নিরিখে তিনি ছিলেন বরাবরই বে-হিসাবী । বছর কয়েক আগে তিনি আর্থিক দৈন্যতার কারনে পত্রিকার মালিকানা ও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। রাঙামাটি শহরের মাঝের বস্তি এলাকায় তাঁর নিজস্ব বসত ভিটা থাকলেও এক সময় পত্রিকার প্রয়োজনে তিনি এই বসত ভিটা ও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। দৈনিক রাঙামাটি পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রাখার জন্য তিনি রাঙামাটির অনেক নামি-দামী বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সহচার্য নিয়েও পত্রিকাটির প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে পারেননি। বলা যায় যেখানে সাংবাদিকতা পেশায় এসে অনেকে নিঃস্ব থেকে বহু সম্পদের মালিক হয়েছেন সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি সাংবাদিকতার পিছনে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলেন। দৈনিক রাঙামাটির মালিকানা ছাড়ার পর আবারো পাক্ষিক পার্বত্য কন্ঠ নামের একটি পত্রিকা নিয়ে নতুন উদ্যামে সম্পাদক হিসাবে নিজেকে দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা শুরু করেও তিনি তা শেষ করতে পারলেন না। মাঝ খানে খাগড়াছড়ি থেকে দৈনিক পাহাড়ের ডাক নামের একটি পত্রিকা বের করার উদ্যোগ নিলেও সেই উদ্যোগও সফল হননি।
যারা মোখলেছ আংকেলকে কাছ থেকে দেখেছেন তারা সকলেই বলবেন খুবই উদার মনের মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর এই উদারতা তাঁকে সহায় সম্পদ হীন করলেও তিনি তাঁর উদারতার স্বভাব ত্যাগ করতে পারেননি । দৈনিক রাঙামাটি পত্রিকা বের করার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংবাদিকেদের মধ্যে তিনি প্রথম কার গাড়ির মালিক হলেও (নিজের সম্পদ বিক্রি করে কার গাড়ী কিনেছিলেন) পরবর্তীতে এই কার গাড়ী ছেড়ে জীবিকার তাগিদে তিনি রাঙামাটি শহরেই বেশ কিছুদিন অটোরিক্্রা চালিয়েছিলেন। সে সময় কয়েকটি পত্রিকার শিরোনাম ও হয়েছিল তাঁর অটো রিক্্রা চালক হওয়ার ঘটনা। এখানেই শেষ নয় পরবর্তীতে তিনি রাঙামাটি ফিসারী ঘাটের হোটেলটিও নিয়েছিলেন ব্যবসা হিসেবে। রাঙামাটি পৌরসভার কাউন্সিলর এবং রাঙামাটি সদর উপজেলার চেয়ারম্যান পদেও তিনি প্রতিদ্বন্ধিতা করেছিলেন। সব জায়গাতেই ব্যর্থ হওয়ার পরেও তবে কোন কিছুতেই তিনি দমে যাননি । সহায় সম্পদের হিসেবে তিনি যে বেহিসাবী ছিলেন ঠিক নিজের শরীরের প্রতিও তিনি ছিলেন সমান উদাসীন। শরীরে স্ট্রং ডায়াবেটিকস ধরার পরেও তিনি ছিলেন উদাসীন । যার পরিনতি তাঁর অকাল এবং অকস্মাৎ মৃত্যু । ২০১২ সালে আমি কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে ঢাকায় দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে যখন রাঙামাটি ফিওে এসে আবারো নিজের পেশাগত কাজ শুরু করলাম তখন মোখলেছ আংকেল আমাকে দেখলেই পরামর্শ দিতেন ডাক্তারের পরামর্শ মাফিক চলার জন্য। অথচ নিজেই তাঁর ধার ধারতেন না।
সাংবাদিক ও সম্পাদক মোখলেছ-উর-রাহমান ভূইয়ার আরো অনেক পরিচয়ের মধ্যে তাঁর পরিচয় ছিল তিনি একজন কবি ও সাহিত্যিক এবং ভাল এবং স্পস্টবাদী বক্তা । বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় সবাইকে কথার মারপ্যাচে সন্তুস্ট রাখার যে বিদ্যা সে বিদ্যায় তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না ফলে তিনি অনেকের কাছেই ছিলেন অপ্রিয় । বিভিন্ন সভা সমাবেশে বক্তব্য রাখার সময় অনেকে অতংকে থাকতেন এই ভেবে যে কখন তিনি কার হাঠে হাঁড়ি ভেঙ্গে দেন। তিনি রাঙামাটি জেলা ক্রীড়া সংস্তার কার্য নির্বাহী পরিষদের সদস্য, রাঙামাটি রাইফেল ক্লাবের সাধারন সম্পাদকসহ আরো অনেক সংগঠনের দায়িত্ব পালন করছিলেন। কর্মজীবনের শুরুতে সরকারী চাকুরীর মাধ্যমে যাত্রা শুরু করলেও স্থিতু হতে পারেননি।
আমি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে সব সময় সম্মান এবং শ্রদ্ধা করেছি । ২০১৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের আরেকজন প্রবীন সাংবাদিক শৈলেন দার মৃত্যুর এক বছর পেরুতে না পেরুতেই মোখলেছ আংকেল এর মতো আরেকজন প্রবীন সাংবাদিকের চির প্রস্থান রাঙামাটির সাংবাদিকতায় একটি বিশাল শুন্যতার সৃষ্টি করেছে যা কখনো পূরন হবার নয়। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা করি তিনি তাঁকে পরপাড়ে চিরশান্তিতে রাখুন। তাঁর এই মৃত্যুর শোক তাঁর স্ত্রী, সন্তান, ভাই বোন এবং অসংখ্য আত্বীয়-স্বজন যাতে সইতে পারেন সেই শক্তি মহান সৃষ্টি কর্তা তাঁদের দিক এই প্রার্থনা করি। মোখলেছ আংকেল এই পার্থিব জগতে আপনি ভাল থাকতে না পারলেও পরপারের চির স্থায়ী ঠিকানায় আপনি চির সুখে থাকুন । এই পৃথিবী নামক গ্রহে আপনার সাথে আর দেখা হবেনা তবে চিরস্থায়ী ঠিকানায় দেখা হবে ইনাশাল্লাহ ।
***(লেখক সাংবাদিক ও অধ্যক্ষ,রাঙামাটি শিশু নিকেতন)***