পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা অভিযোগ করে বলেছেন, সরকার তথা শাসক গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলে সম্পুর্নভাবে সকল ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে প্রতারণা করে চলেছে। ১৯৯৭সালের সম্পদিত পার্বত্য চুক্তির ১৭ বছরেও সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ব্যবস্থপনার সংশোধনীর উদ্যোগ গ্রহন করেনি। বরং সরকার উন্নয়ন ও নিরাপত্তার নামে জুম্মদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্তি করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।
জুম্ম জনগনের অনেকের বসবাসের কোন নিরাপত্তা খোঁজ না পেয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমারে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে উল্লেখ করে সন্তু লারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে এখানো অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। প্রতিটি মহুর্তে শোষন নির্যাতনের শিকার,ভূমি বেদখল ও বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটনা ঘটছে। জনজীবনে সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রজাতীয়তাবাদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে রয়েছে। মানুষের জীবন হানি ও নানানভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। জুম্ম জনগনের অস্তিত্ব বিলুপ্তির জন্য পার্বত্যাঞ্চলের বুকে মুসলিম অধ্যূষিত অঞ্চলে পরিণত করার ষড়যন্ত্র চলছে।
শুক্রবার রাঙামাটি সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট মিলনায়তনে দুদিন ব্যাপী পার্বত্য চট্টগ্রাম হেডম্যান(মৌজা প্রধান) সন্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সন্তু লারমা এসব কথা বলেন।
সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের উদ্যোগে আয়োজিত সন্মেলনে উদ্ধোধক ছিলেন চাকমা সার্কেল চীফ রাজা দেবাশীষ রায়। সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের সভাপতি কংজরী চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন মং সার্কের চীফ মাচিং প্র“ চৌধুরী, ইউএনডিপি-সিএইচটির ডেপুটি ডাইরেক্টর প্রসেনজিৎ চাকমা, আইএলও এর ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর আলোক্সিউস ছিছাম ও এএলআরডি-এর প্রতিনিধি রফিক আহম্মেদ। স্বাগত বক্তব্যে রাখেন সিএইচটি নেটওয়ার্কের সাধারন সম্পাদক শান্তি বিজয় চাকমা।
সন্মেলনের শুরুতে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় দুদিনের সন্মেলন উদ্ধোধন করেন। সন্মেলনে তিন পার্বত্য জেলা থেকে দুই শতাধিক হেডম্যান অংশ গ্রহন করেন।
সন্তু লারমা অভিযোগ করে আরও বলেন, অভ্যন্তরীন সীমানার মধ্যে চোরাচালান ও নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সরকার পার্বত্যাঞ্চলের বুকে আরেক ধরনের সামরিকীকরণ শুরু করেছে অভিযোগ করে সন্তু লারমা বলেন, বাবুছড়া, রুমাসহ বিভিন্ন স্থানে বসতি ও স্কুল উচ্ছেদ করে বিজিবির ক্যাম্প করা হয়েছে। সীমান্ত রক্ষার নামে বিজিবির ক্যাম্প স্থাপন করে পার্বত্যাঞ্চলের অস্তিত্ব বিলুপ্তির প্রক্রিয়া চলছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, পার্বত্য চুক্তি লংঘন করে নির্বাচন না দিয়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ পূর্ণগঠনের নামে সরকার দলীয়করণ করেছে। সরকার আইনের তোয়াক্কা না করে ৫ সদস্য থেকে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একতরফা পরিষদ পূর্ণগঠন করে চুক্তিকে বাধাগ্রস্থ করতে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এ উদ্যোগ গ্রহন করেছে।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩টি ভাষাভাষি ১৪টি জুম্ম জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব বাচিয়ে রাখতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী-অস্থায়ী মানুষের জীবনে শান্তি-উন্নয়ন প্রতিষ্ঠা করতে এবং পাহাড়ী-বাঙালীকে নিয়ে সম্প্রীতিতে যদি বসবাস করতে চাই তাহলে পার্বত্য চুক্তি অবশ্যই যথাযথ বাস্তবায়িত হতে হবে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের বুক থেকে চিরতরে ইসলামীকরনে উগ্রজাতীয়তাবাদে সম্প্রদায়িকতার ষড়যন্ত্র এবং দুর্নীতি-সন্ত্রাসের যে বাস্তবতা সেটা নির্মুলকরনের জন্য পাহাড়ী-বাঙালীর মিলিতভাবে সংগ্রাম আন্দোলন করে যেতে হবে। আজকে সেই বাস্তবতা অনুভব করতে হবে সবাইকে। পার্বত্যাঞ্চলে আজকের আমার চোখে দেখি অন্ধকার। পার্বত্যাঞ্চলে কোন আলো দেখতে পাচ্ছি না। এখানে জীবনধারনের জন্য সুস্থ বাতাস নেই। যেখানে দেখি সরকার জুম্ম জনগনের অস্তিত্ব বিলুপ্তির ষড়যন্ত্রের পদচারণা ।
পার্বত্যাঞ্চলের যে বাস্তবতা সেই বাস্তবতায় জুম্মজনগণ বেশী দিন বাচঁতে পারবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন,পার্বত্যাঞ্চলে ইসলামিক সম্প্রারণবাদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে।এ ইসলামিক সম্প্রারণবাদের কাছে না হয় আমাদের নতজানু হয়ে আত্নসমর্পন করতে হবে, নয়তো এদেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে হবে। অথবা আত্নমর্যাদাকে সম্পূর্নরুপে বিসর্জন দিয়ে দুবেলা দুমূঠো আহারের জন্য জীবনের মূখোমূখি হতে হবে।
সরকার আধিবাসীদের পরিচয় নিয়ে ছিনিমিনি খেলা খেলছে উল্লেখ সন্তু লারমা বলেন, আদিবাসীদের পরিচয় নিয়ে সরকারের সরকারের ছিনিমিনি খেলছে যা মানবধিকার বিরোধী এবং জাতিসংঘের সনদ আইনের পরিপন্থির সামিল।
সরকার উন্নয়ন নামে গলা চেপে ধরে গিলানোর ব্যবস্থা করাচ্ছে দাবী করে সন্তু লারমা বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে উন্নয়ন নামে রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজ দেয়া হয়েছে। সেখানে বাংকার বানিয়ে পুলিশী কড়া প্রহরায় কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। কলেজের প্রিন্সিপাল পুলিশের প্রহরায় চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটিতে এসে ক্লাশ করে চলে যাচ্ছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের খাওয়ার জন্য হোটেল খুলে দেয়া হয়েছে। এক অদ্ভূত ব্যবস্থাপনা। বিশ্বের কোথাও এ ধরনের ব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করা যায়নি। প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ও একই কায়দায় করার চেষ্টা চলছে। আমাদের সে ধরনের উন্নয়ন দরকার নেই। যে উন্নয়ন আমাদের ধ্বংসের কারণ,অস্তিত্বের বিলুপ্তি করে।
তিনি বলেন প্রথাগত হেডম্যানরা কোন রাজনৈতিক দলের না। আবার সরকারের লোকও না। তবে হেডম্যানকে সরকারের কাজ করতে হবে আবার জনগনের সমস্যা সমাধান ও সহযোগিতা করতে হবে। তারা জনগনের বন্ধু। সে জন্য তাদের দায়িত্ব হচ্ছে মৌজার সম্পদ সংরক্ষন করা, মৌজাবাসীর সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা দেয়া। হেডম্যান ও সার্কেল চীফরা অনেকে জাতীয় রাজনীতি আওয়ামীলীগ, বিএনপি জাতীয় পার্টি করেন তা ঠিক না। সে বিষয়টি তাদের ভাববার দরকার।
সন্তু লারমা প্রথাগত নেতৃবৃন্দ হেডম্যান, কারবারী ও সার্কেল চীফদের জুম্ম জনগণের ভূমি অধিকার সংরক্ষন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, সংস্কৃতি রক্ষায় অগ্রনী ভূমিকা পালনের পাশাপাশি পার্বত্য চুক্তির স্বপক্ষে এগিয়ে এসে চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের সামিল হওয়ার আহ্বান জানান।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.