দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদে মলমূত্র ও ময়লা-আবর্জনা নিক্ষিপ্তের ফলে হ্রদের পানি মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছে। হ্রদের পানিতে মারাত্নক কলিফরম জাতীয় জীবানু পাওয়ায় পানের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়ত এভবে হ্রদের পানি দূষিত হতে থাকলে আগামীতে গোসল থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহারের মারাত্নক ঝুঁকিপুর্ন হয়ে উঠবে ।
বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা এনজিও ফোরাম ফর ড্রিংকিং ওয়াটার সাপ্লাই এন্ড স্যানিটেশনের পক্ষ থেকে কাপ্তাই হ্রদের পানিতে পরীক্ষা চালিয়ে মারাত্নক ব্যাক্টেরিয়া জাতীয় জীবানু পাওয়ায় এই আশংকা করা হয়েছে। এনজিও ফোরাম ফর ড্রিংকিং ওয়াটার সাপ্লাই এন্ড স্যানিটেশন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় এনজিও ফোরামের নিজস্ব ল্যাবে কাপ্তাই হ্রদ এলাকার ৬টি স্থান বা ঘাট থেকে পানি সংগ্রহ করে এই পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে কাপ্তাই হ্রদের পানি সংগ্রহ করে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে নিজস্ব ল্যাবে এই পরীক্ষা হয়। স্থানগুলোর মধ্যে রাজবাড়ি এলাকা থেকে ১শ মিলিলিটার পানি থেকে মোট কলিফরমের(ব্যাক্টেরিয়া জাতীয় জীবানূ) মাত্রা পাওয়া যায় ৪০ হাজার ও ফিকেল কলিফরম ২০ হাজার, বনরুপা এলাকায় কলিফরম মাত্রা হচ্ছে ৩লক্ষ ৬০ হাজার ও ফিকেল কলিফরম ৪০ হাজার, রিজার্ভ বাজার এলাকায় কলিফরমের মাত্রা হচ্ছে ২লক্ষ ও ফিকেল কলিফরম ১লক্ষ ২০ হাজার, তবলছড়ি এলাকায় ১লক্ষ ৬০ হাজার ও ফিকেল কলিফরম ২০ হাজার, ডিপিএইইচই এলাকায় পানির কলিফরমের মাত্রা ৪লক্ষ ও ফিকেল কলিফরম ৪০ হাজার এবং গোলাছড়ি এলাকায় কলিফরমের মাত্রা পাওয়ায যায় ৪হাজার ও ফিকেল করিফরম ২শ। ব্যাক্টেরিয়া জীবানু কলিফরম ও ফিকেল কলিফরম শূন্য অবস্থায় থাকলে তবে সেই পানি নিরাপদ। কিন্তু হ্রদের পানিতে ব্যাপকহারে কলিফরম পাওয়া যাওয়া বর্তমানে মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এমনকি ভবিষ্যতে হ্রদের পানি এভাবে দূষিত হতে থাকলে গোসল বা ব্যবহারে অনুপোযোগী পড়ার আশংকা রয়েছে।
এনজিও ফোরামের রিপোর্টের ফলাফলে বলা হয়েছে কাপ্তাই হ্রদের ধারে শতকরা ৬০ ভাগ লোক বসবাস করে থাকেন। এদের মধ্যে থেকে শতকরা ৮০ ভাগ লোক খাওয়া, রান্না ও গোসল হিসেবে হ্রদের পানি ব্যবহার করে থাকেন। এতে প্রতিদিন ৫টন অপরিশোধিত মানব মল হ্রদের পানিতে ফেলা হচ্ছে। নৌকা যাত্রীদের হ্রদের পানিতে মল ত্যাগ করা, হ্রদের তীরবর্তী কৃষি জমিতে ব্যবহৃত সার ও তিকারক কীটপতঙ্গ নাশক রাসায়নিক পদার্থ হ্রদের পানিকে দূষিত করছে। তাছাড়া যাত্রীবাহী ইঞ্জিন চালিত নৌকার তেল বা ডিজেল ও অপরিকল্পিত বৃক্ষ নিধন ও তীরবর্তী মানুষের আবাসস্থল বেড়ে যাওয়ায় ভূমি ক্ষয় হয়ে হ্রদ ভরাট হচ্ছে ও হ্রদের গুনগতমান হ্রাস পাচ্ছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। কাপ্তাই হ্রদের পানি পরীক্ষা ফলাফলের রিপোর্টের যে মারাত্নক আকারে কলিফরম পাওয়া গেছে তার উদ্ধেগ প্রকাশ করে রাঙামাটির বেসরকারী পরিবেশবাদী সংস্থা গ্লোবাল ভিলেজের সাধারন সম্পাদক ও সাংবাদিক হেফাজতউল বারী সবুজ বলেন, আজ থেকে ২০ বছর আগে এক গবেষণায় এই কাপ্তাই হ্রদের পানি পানে অযোগ্য বলে বলে ঘোষনা করেছিল। বর্তমানে কলিফরমের মাত্রা কয়েকগুন বেড়ে গিয়ে বর্তমানে মারাত্নক আকারে পৌঁছেছে। কিন্তু এইসব কিছু জানা থাকার সত্বেও সরকার এখনো কোন প্রতিরোধ বা কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
রাঙামাটি জেলার প্রাক্তন সিভিল সার্জন ও কাপ্তাই হ্রদের গবেষক ডাঃ সুপ্রিয় তালুকদার বলেন, মূলত মানব দেহ থেকে ত্যাগ করা মল বা পায়খানা থেকে ব্যক্টোরিয়া জাতীয় জীবানু কলিফরম উৎপন্ন হয়। এই কলিফরমের কারণে মানুষের শরীরে ডায়রিয়া, জনডিস্ট, ডিসেন্ট্রি, কৃমিসহ নানা পানিবাহিত রোগ দেখা দেয়। এছাড়া পানিতে গোসল করার কারণে নানান প্রকার চর্ম রোগ দেখা দেয়।
তিনি কাপ্তাই হ্রদে কলিফরম পাওয়া যাওয়ার অন্যতম কারণ হ্রদে যত্রতত্র মল ত্যাগের ফলে উল্লেখ করে বলেন, কাপ্তাই হ্রদের পানির ওপর আজ থেকে ৫/৬ বছর আগে গবেষনা করেছেন। এই গবেষনায় হ্রদের পানিতে মারাতœক কলিফরম পাওয়া গেছে। যা হ্রদের পানি পানের একেবারে অযোগ্য। তিনি কাপ্তাই হ্রদের পানি সরাসরি পান না করার জন্য পরামর্শ দিয়ে বলেন, হ্রদের পানি করলে তার আগে কমপক্ষে আধা ঘন্টা ব্যাপী ফুটিয়ে বিশুদ্ধ করে পান করতে হবে। তা না হলে শরীরে নানান পানিবাহিত রোগ দেখা দিতে পারে। তিনি অপর এক প্রশেশ্নর জবাবে বলেন, জনস্বাস্থ্য কর্তৃক রাঙামাটি শহরে কাপ্তাই হ্রদের পানি সরবরাহ করা হয় তা কতটকু বিশুদ্ধ তার জানা নেই। তবে কতটুকু বিশুদ্ধ করা হচ্ছে তা জানা থাকা প্রয়াজন। তিনি আরও বলেন, প্রতিনিয়ত বিভিন্ন হোটেলের বর্জ্য, আবাসিক এলাকার বাড়ীর পাইপের মাধ্যমে বর্জ্য ও মল হ্রদে ফেলানো, যাত্রীবাহী লঞ্চের যাত্রীদের মল ত্যাগসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন সরাসরি হ্রদে মল ত্যাগের কারণে পানিতে এই মারাত্নক কলিফরম পাওয়া যাচ্ছে। তাই এই কাপ্তাই হ্রদকে এইসব দূষন থেকে রক্ষা করতে হলে সর্ব প্রথমে এলাকার লোকজনদের সচেতনা সৃষ্টি করতে হবে। উল্লেখ্য, ১৯৬১ সালে কর্ণফূলীর খরাস্রোতা নদীর উপর বাঁধ দিয়ে নির্মান করা হয় কাপ্তাই জল বিদ্যূৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এই হ্রদ সৃষ্টির ফলে প্রায় ৭শ বর্গমাইল এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়। ফলে এক লাখের বেশী পাহাড়ি লোকজন উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। এছাড়া এ বাঁেধর কারণে হ্রদটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি মৎস্য উৎপাদন করে দেশের মাছের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে।
–হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.