আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে সোমবার রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক পাহাড়ীদের র স্ব স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা ও সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতকরা ৫শতাংশ শিক্ষা কোটা চালুর দাবীতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়িত হয়নি। চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। নেৃতবৃন্দ অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন, পাহাড়ে সকল পাহাড়ী জাতিসত্বাদের স্ব স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু, দেশের সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতকরা ৫শতাংশ আদিবাসী চালুর দাবী জানান।
পিসিপি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের উদ্যোগে শহরের নিউ মার্কেট প্রাঙ্গনে ঘন্টাব্যাপী মানবনন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। মানববন্ধন চলাকালে সমাবেশে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ম্রানুচিং মারমার সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন পিসিপির কেন্দ্রীয় সভাপতি সুমন মারমা,সাধারন সম্পাদক নিপণ ত্রিপুরা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারন সম্পাদক শান্তিদেবী তংচংগ্যা, পিসিপির রাঙামাটি সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি সুমন চাকমা, শহর শাখার সভাপতি মিলন চাকমা, স্বাগত বক্তব্য রাখেন থোয়াইক্যজাই চাক। মানববন্ধনে পিসিপিও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতাকর্মীরা ছাড়াও কলেজ ও বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
সভাপতির বক্তব্যে ম্রানুচিং মারমা আদিবাসীদের স্ব স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা ও সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫ শতাংশ আদিবাসী কোটা চালু করার জন্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আহবান জানান।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যা বলেন,বাংলাদেশ বহু ভাষা এবং বহু জাতির দেশ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য পৃথিবীর সকল ভাষা সমান মর্যাদা প্রদান এবং বিকাশের রাষ্ট্র কর্তৃক উদ্যোগ গ্রহণ করা। এ জন্য জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২০২২-২০৩২ সাল পর্যন্ত “আদিবাসী ভাষা বর্ষ” হিসেবে ঘোষণা করেছে। ফেব্রæয়ারি মাস এলে বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কিছু কিছু সভা সেমিনার আয়োজন থাকলে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার চালুর কোন উদ্যোগ দেখা যায় না। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নসহ মোতাবেক আদিবাসীদের স্ব স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা ও সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতকরা ৫ভাগ আদিবাসী কোটা চালু করার দাবি জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা বলেন, ভাষা কতগুলো কেবল বুলি সর্বস্ব নয়, ভাষা একটি জাতির সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের স্বাক্ষর।ভাষার মর্যাদার জন্য এদেশে আন্দোলন হয়েছে। অথচ এদেশে আদিবাসীদের ভাষা আজ অসংরক্ষিত ও হুমকির মুখে। আদিবাসীদের ভাষা নিয়ে রাস্তাঘাটে অফিস আদালতে বিভিন্ন জায়গায় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হচ্চে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গঠিত স্বাধীন দেশে আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণ ও স্বীকৃতির জন্য লড়াই করতে হচ্ছে তার জন্য সরকার এবং রাষ্ট্রের লজ্জা হওয়া উচিত।
তিনি আরো বলেন, শিক্ষা সংবিধানে মৌলিক অধিকার সরকার তা নিশ্চিত করতে বাধ্য কিন্তুআদিবাসী শিক্ষার্থীরা আজো মায়ের ভাষায় পড়তে পারছেনা, লিখতে পারছেনা এবং শিখতে পারছেনা। বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন রাঙ্গামাটি ঘোষণা -১৯৯৮, দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপ্রত্র -২০০৫, জাতীয় শিক্ষানীতি -২০১০ , জাতীয় শিক্ষা আইন -২০১৬ , পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির খ খন্ডের ৩৩(খ) ধারার পাহাড়ি শিশুদের মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের বিষয়গুলো থাকলেও আজ অবধি বাস্তবায়ন হচ্ছেনা।ফলে শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসীদের পরিচয় এবং জীবনধারা নিয়ে অনেক অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে বাঙালী শিক্ষার্থীদের মাঝে আদিবাসীদের নিয়ে ভুল ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে তা প্রত্যাহার করে স্ব স্ব জাতির বিশেযজ্ঞ নিয়ে যথাযথ ও সঠিক তথ্য তুলে ধরতে হবে। তাছাড়া বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার কারণে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ছে। তারা নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা নিতে পারছেনা এবং গুনগত মানের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, নানা বঞ্চনা -নিপীড়ন জয় করে পাহাড়ি ছাত্ররা বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির কোটা সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। তা ৫% উন্নীত করতে হবে। ২০০২ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের শিক্ষা বিষয়ক কমিটি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ও বিভিন্ন উচ্চ প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের দেয়া কোটা সংক্রান্ত দাবি দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সুমন মারমা বলেন, ফ্রেব্রুয়ারী মাস আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের মাস।এই রাষ্ট্রে ভাষার জন্য নানান শ্রেণির মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশে বসবাসরত ৫০টির অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক পর্যায়ে স্ব স্ব ভাষায় শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য। একটা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা রক্ষা করার জন্য সেই ভাষার লিখিত রূপ না থাকা হতাশার। আদিবাসী ভাষাগুলোকে লিখিত রূপ দেয়ার জন্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, ইউনেস্কোর তথ্যমতে প্রতি সাপ্তাহে একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। একটি ভাষা হারিয়ে গেলে সে জাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সে হারিয়ে যেতে বসা ভাষার সংরক্ষণ করার দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের। কিন্তু এই রাষ্ট্র তাঁর দায়িত্ব পালন করতে পারছেনা।বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসীদের ভাষা,সংস্কৃতিকে অবহেলা করে রাখা হয়েছে। রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা গেঁড়াকলে আদিবাসীরা তাদের স্ব স্ব ভাষায় কথা বলতে পারছে না। তিনি আদিবাসীদের নামের আগে জনাব,বেগম ট্যাগ লাগিয়ে দেয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানান। যে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বুনেছিল সেই স্বাধীন রাষ্ট্র কীভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, জাতি বিলুপ্ত করতে ষড়যন্ত্র করতে পারে সেই প্রশ্ন থেকে যায় বলে উল্লেখ করেন।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.