প্রতি বছর মে থেকে তিন মাস পর্ষন্ত এই সময়ে সচরাচর রাঙামাটিসহ পার্বত্য তিন জেলায় প্রত্যান্ত ও দুর্গম এলাকায় জুম চাষের উপর নির্ভশীল জুম চাষীদের মাঝে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়ে থাকে। কিন্তু এ বছর মরণঘাতি করোনা ভাইরাস সংক্রমণের মোকাবেলার কারণে জুমিয়াদের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলেছে। ফলে এবার জুমিয়াদের মাঝে খাদ্য সংকটটি একটু বেশী বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে জেলা প্রশাসন বলছে জেলায় কোথাও কোন খাদ্য সংকট নেই। জেলার সব উপজেলায় পর্যাপ্ত পরিমাণের খাদ্য উদ্ধুতি ও মজুদ রয়েছে। যে জায়গা খাদ্য দরকার সেখানে খাদ্য পৌছে দেয়া হচ্ছে।
একাধিক সূত্রে জানা যায়,দেশের এক দশাংশ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান)। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ এগার ভাষাভাষি ১৩টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যান্ত এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীদের মধ্যে অধিকাংশ লোকজন জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উচু পাহাড়ের পাদদেশে গাছ-গাছালি কেটে আগুনে পুড়িয়ে জমিতে যে চাষ করা হয় তার নাম হচ্ছে জুম চাষ। সাধারনত জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে পাহাড়ের ঢালু জায়গা পরিস্কার করে মার্চ-এপ্রিল মাসে আগুনে পুড়িয়ে মাটি উপযুক্ত করা হয়। এর পর এপ্রিল-মে মাসে বৃষ্টি শুরুর পূর্বে সুঁচালো দা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে একসঙ্গে ধানসহ নানা সব্জির বীজ বপন করা হয় এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে জুমের পাকা ধান ঘরে ঘরে তুলে থাকেন জুমিয়ারা।
এই তিন মাসে জুমিয়াদের খাদ্য সংকটে পড়তে হয়। কিন্তু এ বছর বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের দুর্গম এলাকায়, জুরাছড়ি উপজেলার দুমদুম্যা ইউনিয়নের দুর্গম ৪,৫ ও ৬নং ওয়ার্ডে, বিলাইছড়ি উপজেলায় ফারুয়া ও বড়থলি ইউনিয়নে ও বরকলের দুর্গম সীমান্তবর্তী ঠেগাসহ কয়েকটি এলাকায় জুমিয়াদের খাদ্য সংকট বিরাজ করছে। বিশেষ করে করোনা ভাইরাসের কারণে লকডাউনের কারণে স্থানীয় বাজারগুলো বন্ধ থাকায় উৎপাদিত পণ্য ঠিকমত বেচাকেনা করতে না পারায় এসব এলাকায় বসরবাসরত জুমিয়া পরিবারের মাঝে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। তবে সাজেকের কিছু কিছু এলাকায় সরকারী-বেসরকারীভাবে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হলেও অতি দুর্গম এলাকায় বসবাসকারীরা অউন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে তারা ত্রাণ নিতে পারছে না। এসব ত্রাণ পেলেও অতি দুর্গমতায় সেগুলো বহন করে নিয়ে যেতে এক থেকে দুই দিন সময় লাগছে তাদের।
সাজেক ইউপি সদস্য সুশীলা চাকমা ও হীরানন্দ ত্রিপুরা জানান, সাজেক ইউনিয়নটি ফেনী জেলার সমান আয়তনের। বেশিরভাগ এলাকা দুর্গম এবং দারিদ্র প্রবণ। গ্রীস্ম ও বর্ষাকাল মানেই এখানে খাদ্য সংকটের মৌসুম।
স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা ‘আশিকা ডেভেপমেন্ট এসোসিয়েটস’- এর প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর বিমল কান্তি চাকমা জানান, সাজেক ইউনিয়নের অধিকাংশ স্থায়ী বাসিন্দাই জুমজীবি এবং দিনমজুর। বছরের এই সময়টাতে পুরো এলাকাজুড়ে খাদ্য ও কাজের সংকট সৃষ্টি হয়। সরকারী-বেসরকারিভাবে স্বল্পমূল্যের রেশনিং চালু করা গেলে মানুষের জীবন ও জীবিকা স্থায়িত্বশীল হবে বলে তার ধারনা।
সাজেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নেলসন চাকমা নয়ন বলেন, সাজেক এলাকায় শুধু খাদ্য নয় বহমাত্রিক সংকট রয়েছে। এখানে অধিকাংশ লোকজন প্রত্যান্ত এলাকায় বসবাস করে একমাত্র জুম চাষ ও কৃষি উপর জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বর্তমান সময়ে এখানকার উৎপাদিত পণ্য ঠিকমমত বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে না পারায় লোকজনের আয় উপার্জন নেই। যার ফলে আর্থিক অনটনসহ বহুমাত্রিক সংকটে মধ্যে থাকতে হচ্ছে তাদের।
দুমদুম্যা ইউপি মেম্বার কালাচোগা তংচংগ্যা জানান, এখানকার লোকজন জুম চাষের উপর নির্ভশীল। যার কারণে এই মৌসুমে খাদ্য সংকটটা একটু বেশী দেখা দেয়।
দুমদুম্যা ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাধন কুমার চাকমা জানান, এপ্রিল থেকে আগষ্ট পর্ষন্ত এই এলাকায় খাদ্য সংকট দেখা দেয়। তবে এই সময়ে পাশ^বর্তী ভারত থেকে চাউল কিনে আনতো লোকজন। কিন্তু এবছর করোনা পরিস্থিতির কারণে সেখানে লকডাউন থাকায় চাউল আনতে না পারায় তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে এখানে প্রতি কেজি চাউল ৯০টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। তিনি খাদ্য সংকট মোকাবেলার জন্য হেলিকপ্টারযোগে সেনাবাহিনী ও বিজিবির মাধ্যমে ত্রাণ সহায়তা জন্য দাবী জানান।
‘আশিকা ডেভলপমেন্ট এসোসিয়েটস’-এর নির্বাহী পরিচালক বিপ্লব চাকমা জানান, ২০১৭ সালে সাজেক এলাকায় ভয়াবহ খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়েছিলো। তাঁর আগেও ‘ইঁদুর বন্যা’র কবলে পড়ে ব্যাপক ফসলহানির মুখে মানুষ সাজেক ছেড়ে পালানোর ঘটনা ঘটেছিল। এলাকাটির অধিকাংশ মানুষ সুপেয় পানির সুযোগ বঞ্চিত। অভাব-অশিক্ষায় মানবেতর জীবনযাপন করেন। জিও-এনজিও ক্লোজডলি দীর্ঘ মেয়াদে কাজ করলেই ওখানে স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে। আর তখনিই মানুষের অন্যান্য মৌলিক অধিকারগুলো পূরণে অগ্রগতি মিলবে বলে তিনি মনে করেন।
জুরাছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহাফুজুর রহমান জানান, দুমদুম্যা ইউনিয়নে করোনা পরিস্থিতির কারণে সেখানকার লোকজন তাদের উৎপাদিত পন্য বিক্রি করতে পারছে না। তাই এই খাদ্য সংকট মোকাবেলায় হেলিকপ্টরের মাধ্যমে ত্রাণ সহায়তা দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসকের বরাবরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে সেখানে দশ টাকার চাউল বিক্রির কর্মসূচি চালু করার জন্য চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিলাইছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীরোত্তম তংচংগ্যা জানান, এই সময়ে জুমিয়া পরিবারের মাঝে খাদ্য সংকট থাকে। তবে যতটুকু পারা যায় তাদের জন্য উপজেলা থেকে খাদ্য সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশেষ করে উপজেলার ফারুয়া ও বড়থলি ইউনিয়নে জুমিয়াদের মাঝে কিছুটা খাদ্য সংকট চলছে। কারণ বর্তমানে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সেখানে খাদ্য পৌছানো সম্ভব হচ্ছে না।
বরকল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বিধান চাকমা জানান, বরকল উপজেলায় অধিকাংশ মানুষ শ্রমজীবি,জুম চাষী ও স্থানীয় বাজারে পন্য বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কিন্তু করোনা ভাইরাসে লকডাউনের কারণে বাজারগুলো বন্ধ থাকায় উৎপাদিত পন্য বাজারে বিক্রি করতে পারছে না।
তিনি আরো জানান,বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকা ঠেগা, হুভবাংসহ কয়েকটি এলাকার মানুষ করোনা ভাইরাসের কারণে ব্যবসা-বানিজ্য বন্ধ থাকায় নিজেদের উৎপাদিত পন্য বিক্রি করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে চাল ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে না পারায় খাদ্য সংকটে রয়েছেন। তিনি আরো জানান, এসব এলাকায় শর্তসাপেক্ষে বাজার-হাটবার গুলো খুলে দিলে কিছুটা হলেও এই খাদ্য সংকট দুর হতে পারে।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশীদ বলেন,জুরাছড়ি উপজেলার দুমদুম্যা এলাকায় খাদ্য সংকটের বিষয়টি সম্পূর্ন আলাদা। ইতোমধ্যে সেখানে খাদ্য সরবরাহ করার জন্য সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করা হয়েছে। আবহাওয়া খারাপ থাকায় সেখানে খাদ্য পৌছানো যাচ্ছেন না। তবে ইতোমধ্যে কিছু খাদ্য সেখানে পৌছানো হয়েছে। এছাড়া জেলায় কোথাও কোন খাদ্য সংকট নেই। জেলার সব উপজেলায় পর্যাপ্ত পরিমাণের খাদ্য উদ্ধুতি ও মজুদ রয়েছে। যে জায়গা খাদ্য দরকার সেখানে খাদ্য পৌছে দেয়া হচ্ছে। তাই খাদ্য সংকট চলছে কথাটি একেরারেই সঠিক নয়।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.