সোমবার রাঙামাটিতে নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতাঃ বর্তমান পরিস্থিতি,আইন ও করনীয় শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মতবিনিময় সভায় বক্তারা পারিবারিক সহিংসতার আইনের বিভিন্ন মতামত তুলে বলেন,নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সামাজিক ও পরিববারিকভাবে সচেতনা সৃষ্টিরসহ নারী-পুরুষের বৈষম্য দুরতে করতে হবে। পাশাপশি নারীদের সুরক্ষা দিতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
মতবিনিময় সভায় বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে পারিবারিক আদালত না থাকায় বিবাহ বিচ্ছেদ,দেনমোহর আদায়,ভরণপোষন আদায়, সন্তানের হেফাজত, সন্তানের অভিভাবকত্ব বিষয়ে আইনের কোন সমাধান পাওয়া সম্ভব হয় না। যদিও পাহাড়ী নারীদের প্রথাগত আদালতে বিচার চাওয়ার সুযোগ থাকলেও বাঙালী নারীরা যথাযথ প্রতিকার পাচ্ছে না।
স্থানীয় এনজিও হিমাওয়ান্তির উদ্যোগে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহায়তা আশিকা সন্মেলন কক্ষে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন রাঙামাটি চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজেষ্ট্রেট মোহাম্মদ খালেদ। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক রীণা রায়ের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন রাঙামাটির যুগ্ন জেলা ও দায়রা জজ আজিজুল হক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(অপরাধ) শহীদুল্লাহ,রাঙামাটির জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর মোঃ রফিকুল ইসলাম ও রাঙামাটি আইনজীবি সমিতির সভাপতি প্রতীম রায় পাম্পু। স্বাগত বক্তব্যে রাখেন হিমাওয়ান্টির নির্বাহী পরিচালক টুকু তালুকদার।
মতবিনিময় সভায় পারিবারিক সহিংসতা(প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) বিধিমালা ২০১৩এর উপর আলোক পাঠ করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা অর্পিতা রায় এবং পারিবারিক সহিংসতা ক্ষেত্রে রাঙামাটি জেলার বর্তমান পরিস্থিতির উপস্থাপন করেন হিমাওয়ান্টির কর্মকর্তা অনিতা দেব বর্মন।
দিন ব্যাপী মতনিমিয় সভায় পুলিশ কর্মকর্তা, এনজিও কর্মকর্তা, বিভিন্ন নারী সংগঠনের নেত্রী আইনজীবিরা ও সংবাদ কর্মীরা অংশ গ্রহন করেন।
পারিবারিক সহিংসতা ক্ষেত্রে রাঙামাটি জেলার বর্তমান পরিস্থিতির উপস্থাপনে বলা হয়, পারিবার থেকে নারীরা শতকরা ৮৭ ভাগ সহিংসতার শিকার হয়। এর মধ্যে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় শতকরা ৬৫ ভাগ। এক্ষেত্রেও পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীরা পিছিয়ে নেই। পার্বত্য নারীরা বিভিন্নভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। তবে এর মুল কারণ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে মামলার দীর্ঘ সূত্রিতা,আইনী প্রক্রিয়া জটিলতা, আসামীদের শাস্তি না হওয়ার কারণে নারীর প্রতি যৌন নিপীড়নের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাঙামাটিতে জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রতিষ্ঠাতার পর থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ৩৩২টি মামলার মধ্যে একটি মাত্র মামলার রায়ে আসামীর সাজা হয়েছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে রাঙামাটি আইনজীবি সমিতির সভাপতি প্রতীম রায় পাম্পু বলেন, পারিবারিক সহিংসতা(প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) বিধিমালা ২০১৩এর তড়িৎ বিচার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। তবে এ আইনের মামলায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থারা নিজেদেরকে এগিয়ে চলার চেষ্টা করার সুযোগ রয়েছে। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের প্রেক্ষাপটে বিধিবদ্ধ কোন আইন নেই। আদিবাসী নারীরা সম্পক্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে পৈত্রিক সম্পক্তি থেকে নারীরা বঞ্চিত হচ্ছে। তাই আদিবাসী নারীদের সম্পত্তির ক্ষেত্রে যে বৈষম্য রয়েছে তা দূরীকরণ করা দরকার।
রাঙামাটির আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, নারীদের প্রতি কোন প্রকার সহিংসতা করা যাবে না। কারণ একজন নারী হলেন জননী,বোন, স্ত্রী ও পরম ভালবাসার আত্বীয়। তাই নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে সামাজিক ও পরিববারিকভাবে সচেতনা সৃষ্টিরসহ নারী-পুরুষের বৈষম্য দুরতে করতে হবে। পাশাপশি নারীদের সুরক্ষা দিতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহীদুল্লাহ বলেন, এই আইনটি কিভাবে নেওয়া হবে এবং কিভাবে প্রয়োগ করা হবে সেই বিষয়টি দেখতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে যে সব আইন রয়েছে সবগুলো একটি প্লাটফরমে নিয়ে আসতে হবে। তিনি পারিবারিক সহিংসতা(প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) বিধিমালা ২০১৩এর আরো সংশোধনী আনার দরকার বলে মতামত তুলে ধরেন।
রাঙামাটির যুগ্ন জেলা ও দায়রা জজ আজিজুল হক বলেন, একটা ভাল উদ্যোগ নিয়ে আইন করা হয়। এই আইনকে নারী ও শিশু দমন ট্রাবুন্যাল আইনের সংশোধন করা যায় তাহলে আরও বেশী কার্যকরী হবে।
প্রধান অতিথি ছিলেন রাঙামাটি চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজেষ্ট্রেট মোহাম্মদ খালেদ বলেন, পারিবারিক সহিংসতা আইনটি করার বড় কারণ হল পারিবারিক সহিংসতা এটা যে একটা অপরাধ বা একটা বিষয় সেটা কিন্তু আগে কখনও সংজ্ঞায়িত হয়নি। এই আইনের মাধ্যমে এই প্রথম বিষয়টি আলোচনায় আসছে।
তিনি আরো বলেন, এ আইনের অনেকগুলো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেটা আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে। এবং এই আইন নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন ইস্যূতে এবং স্টোকহোল্ডারদের মধ্যও হয়তো বিতর্ক রয়েছে ও বিতর্ক থাকবে। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ নিয়ে আমরা কি ধরনের অভিজ্ঞতা পাচ্ছি সেটা চিহিৃত করতে হবে। আর এ জন্য আজকের এই মতবিনিময় সভার আয়োজন।
তিনি বলেন, বিশেষ করে পার্বত্য প্রেক্ষাপটে আদিবাসী বা পাহাড়ী জনগনের নিজস্ব কৃষ্টি,সংস্কৃতি, নিজস্ব পারিবারিক মূল্যবোধগুলো রয়েছে সেগুলোর প্রেক্ষাপটে আইনগুলো প্রয়োগ কেমন হবে সে বিষয়টিও আলাদাভাবে দৃষ্টি আকর্ষন করার সুযোগ থাকবে।
এ মতবিনিময় সভায় যা সুপারিশ আসবে ভবিষ্যতে আইনটির সংযোজন এবং সংশোধন করে একটি কার্যকরী আইন করা যায় কিনা তার একটা গঠনমূলক সুন্দর প্রস্তাবের চিন্তার খোরাক যোগাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.