পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজিত সমাজ ব্যবস্থার আলোকে পারিবারিক আদালত স্থাপনের বিষয়টি এ অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য খুব একটা সুফল বয়ে আনবে না। তবে এটি স্থাপনের আগে কোন ধরনের বাধা ও পার্বত্য অন্যান্য আইনের সাথে সাংঘর্ষিক কিনা তা যাচাই-বাছাই ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে নিয়ে কোন আইন প্রনয়ন করতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে পরামর্শ ও জেলা পরিষদের সাথে আলোচনা করার জন্য তাগিদ দেন।
শনিবার রাঙামাটিতে আয়োজিত পারিবারিক আদালতঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রেক্ষাপট র্শীষক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সন্তু লারমা এসব কথা বলেন।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ সন্মেলন কক্ষে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাষ্ট(ব্লাষ্ট) রাঙামাটি ইউনিটের উদ্যোগে ইউএনডিপি-সিএইচডিপি ও ইইউ-এর সহায়তায় মতবিনিময় সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়। ব্লাস্টের রাঙামাটি ইউনিটের পরিচালনা কমিটির সভাপতি এ্যাডভোকেট পরিতোষ কুমার দত্তের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবি এ্যাডভোটে ইদ্রিসুর রহমান। বক্তব্যে রাখেন ব্লাষ্টের উপ-পরিচালক মাহবুবা আক্তার ও ইউএনডিপি-সিএইচডিপি’ এর জেন্ডার এন্ড লোকাল কনফিডেন্স বিল্ডিং-এর ক্লাস্টার লিডার ঝুমা দেওয়ান। প্যানেল আলোচক ছিলেন জাতীয় মানবধিকার কমিশনের সদস্য নিরুপা দেওয়ান,রাঙামাটি জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর এ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম ও ব্লাষ্টের প্যানেল ল`ইয়ার এ্যাডভোকেট সুস্মিতা চাকমা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ব্লাষ্টের রাঙামাটি ইউনিটের সমন্বয়কারী এ্যাডভোকেট জুয়েল দেওয়ান।
মতবিনিময় সভায় অংশ গ্রহনকারী অন্যান্যদের মধ্যে মতামত ব্যক্ত করেন, শিক্ষাবিদ প্রফেসর মংসানু চৌধুরী, সাবেক যুগ্ন জজ এ্যাডভোকেট দীপেন দেওয়ান, প্রবীন সাংবাদিক সুনীল কান্তি দে, রাঙামাটি প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন রুবেল, রাঙামাটির জেলা বার এসোসিয়েশনের সাধারন সম্পাদক লাথোয়াই মারমা, এ্যাডভোকেট প্রতীম রায় পাম্পু, নারী নেত্রী টুকু তালুকদার, মহিলা পরিষদ নেত্রী মিনারা আরশাদ, এ্যাডভোকেট ভুপাল চাকমা প্রমুখ। মতবিনিময় সভায় সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ, আইনজীবিসহ বিভিন্ন পেশা শ্রেনী নেতৃবৃন্দ অংশ নেন।
মতবিনিময় সভায় বলা হয়, দেশের ৬১টি জেলায় পারিবরিক আদালত স্থাপিত হলেও তিন পার্বত্য জেলায় স্থাপিত হয়নি। তাই জনস্বার্থে তিন পার্বত্য জেলায় পারিবারিক আদালত স্থাপনের জন্য ব্লাষ্টের পক্ষ থেকে ২৬ এপ্রিল ২০০৯ সালে রীট মামলা দায়ের করা হয়। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোট বিভাগে শুনানীর অপেক্ষায় রয়েছে।
সভায় বক্তারা বলেন,পার্বত্য চট্টগ্রামে পারিবারিক আদালত স্থাপনের বিপক্ষে নয়। তবে তিন পার্বত্য জেলায় পারিবারিক আদালত স্থাপিত হলে পাহাড়ী সম্প্রদায়ের লোকজন খুব একটা ভাল সুফল পাবে না। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী সম্প্রদায়ের কোন লিখিত আইন নেই। তা না হলে পারিবারিক আইনের বিচার প্রার্থীরা সুবিচার থেকে বঞ্চিত হবে। লিখিত আইন লিপিবদ্ধের পর ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিসহ অন্যান্য আইনের সাথে সংগতি রেখে পাহাড়ী সম্প্রদায়ের জন্য পারিবারিক আদালত স্থাপন করা দরকার। বক্তারা পারিবারিক আইন আদালত স্থাপন নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের পরামর্শসহ এ অঞ্চলের সুশীল সমাজের সাথে আরো আলাপ-আলোচনা বা ব্যাপক মতামত নেয়া দরকার বলে মতামত তুলে ধরেন।
সন্তু লারমা তার বক্তব্যে আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় অধ্যূষিত অঞ্চল হিসেবে বিশেষ শাসন ব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। মানুষের বেচে থাকার জন্য যে বাস্তবতার প্রেক্ষাপট রয়েছে তার বেশ কিছু পরিবর্তন, যুযোপযোগী ও উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষ বিশেষ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নিরিবিলিভাবে বসবাস করে আসছিলেন। তবে জাতীয়ভাবে কোন কিছু চাপিয়ে দেয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসব নানান সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি বলেন, পারিবারিক আদালতে যে সমস্ত বিষয় রয়েছে সেগুলো এ অঞ্চলের বাস্তবতা ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষিতে হেডম্যান, কারবারী, সার্কেল চীফের আদালতে বিচার করা সম্ভব। তারা যে ব্যবস্থাপনায় বিচার কাজ সম্পাদন করে থাকেন তাতে শুধুমাত্র উপজাতীয়দের জন্য নয় সমস্ত মোৗজা বা গ্রামের বসবাসকারী বিচার কার্য্য সম্পাদন করে থাকেন। এছাড়া প্রথাগত হেডম্যান ও কারবারীদের দায়িত্ব হচ্ছে গ্রাম বা মৌজার শান্তি, আইন-শৃংখলা বজায় রাখা ও সমাজকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নেয়া।
প্রধান আলোচক বক্তব্যে চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় পারিবারিক আদালত স্থাপনের আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদসহ সুশীল সমাজের সুচিন্তিত মতামত নেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মত দেন। তিনি বলেন,পারিবারিক আদালতের ক্ষেত্রে পাহাড়ীদের বেলায় কিছুটা সমস্যা হবে। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের সমাজ ব্যবস্থায় প্রথা সার্কেল চীফ, হেডম্যান ও কারবারীদের ভূমিকা রয়েছে এবং তাদের বিচারিক ক্ষমতা রয়েছে। এ অঞ্চলের পাহাড়ীদের নিজস্ব স্বকীয়তা, পরিচয় ও অধিকার জড়িত রয়েছে। এছাড়া এ পারিবারিক আইনে সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হবে কিনা সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.