দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙামাটির ২৯৯ নং আসনে আওয়ামীলীগ,বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে ত্রিমুখী লড়াই হলেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে আওয়ামীলীগের প্রার্থী দীপংকর তালুকদার(নৌকা) এবং সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সমর্থিত(পিসিজেএসএস) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী উষাতন তালুকদারের(সিংহ) মধ্যে। দশ উপজেলায় প্রচার-প্রচারনায় দুজনেই পেয়েছেনও ব্যাপক জনসমর্থন।
এবার রাঙামাটি আসন থেকে ৬ন প্রতিদ্বন্ধি প্রার্থী মধ্যে রয়েছেন আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রার্থী দীপংকর তালুকদার (নৌকা), বিএনপির প্রার্থী মনিস্বপন দেওয়ান(ধানের শীষ), সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পিসিজেএসএস’র সমর্থিত ও স্বতন্ত্র প্রার্থী উষাতন তালুকদার(সিংহ), জাতীয় পার্টির প্রার্থী পারভেজ তালুকদার(লাঙ্গল), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়াকার্স পার্টির প্রার্থী জুই চাকমা(কোদাল), বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী জসীম উদ্দীন তালুকদার(হাতপাখা)। পাহাড়ী-বাঙ্গালী অধ্যূষিত এ আসনে এবারের মোট ভোটার রয়েছে ৪ লাখ ১৮ হাজার ২১৭ (পুরুষ-২লাখ ২০হাজার ৩৫৪, মহিলা-১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৬৩জন)।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙামাটি আসনে হেভিওয়েট প্রার্থীদের মধে আওয়ামীলীগের প্রার্থী দীপংকর তালুকদার রয়েছেন । তিনি ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে এ আসন থেকে দু’দুবার সংসদ সদস্য হিসেবে জয়ী হন। তবে তিনি ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি’র মনিস্বপন দেওয়ানের কাছে হেরে যান। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পরবর্তী সময়ে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে পিসিজেএসএসএর সাথে আওয়ামীলীগের প্রার্থী দীপংকর তালুকদারের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়নের কারণে বিএনপির প্রার্থী মনিস্বপন দেওয়ানকে সমর্থন দিয়েছিল। ২০০১ সালে নির্বাচনে মনি স্বপন দেওয়ান দীপংকর তালুকদারকে ১৭ হাজার ৭শ ৪৪ ভোটার ব্যবধানে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মনিস্বপন দেওয়ান ৬৮ হাজার ৭শ ৪৪ ভোট এবং দীপংকর তালুকদার পান ৫১ হাজার ভোট পান। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পিসিজেএসএস’র সমর্থিত ও স্বতন্ত্র প্রার্থী উষাতন তালুকদারের কাছ থেকে প্রায় ১৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন দীপংকর তালুকদার। তবে এবারের দীপংকর তালুকদার বিজয়ের জন্য মরিয়া হয়ে দিনে রাতে সমানতালে প্রচারণা চালিয়েছেন। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন, সরকারের উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রাখাসহ বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের কাছে টানার চেষ্টা করেছেন। যদিও স্থানীয়ভাবে তিনি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেননি। তবে এবারের নির্বাচনে আঞ্চলিক দল নানিয়ারচর, লংগদু, বাঘাইছড়ি উপজেলাগুলোতে অংশিক আধিপত্যবিস্তার থাকা এমএন লারমা গ্রুপের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি(সংস্কারপন্থী), গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের পক্ষ থেকে সমর্থন দিয়েছে। তাই এসব এলাকায় দীপংকর তালুকদারকে সমর্থন দেয়ায় ওই ভোটগুলো তার পকেটে চলে গেলে বিজয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। আওয়ামীলীগ প্রার্থী দীপংকর তালুকদার জানান, তিনি নির্বাচিত হলে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন, প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এবং পর্যটন সেক্টরকে আধুনিকায়ন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের হারানোর গৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
নির্বাচনে অপর হেভিওয়েট প্রার্থী হচ্ছেন পিসিজেএসএস’র সমর্থিত স্বতন্দ্র প্রার্থী ও বর্তমান সাংসদ উষাতন তালুকদার। দীর্ঘ দু’যুগেরও অধিক সশস্ত্র আন্দোলনের ফলে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পর দ্বিতীয়বারের মতো পিসিজেএসএস নিজস্ব প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করছে। দলের নিজস্ব প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করায় পিসিজেএসএসএর নেতাকর্মীদের মাঝে উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। রাঙামাটির দশ উপজেলায় পিসিজেএসএসএর বিপুল সমর্থক ও নেতাকর্মী রয়েছে। তিনিও বিরামহীনভাবে দশ উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে জনসংযোগ ও জনসভা চালিয়েছেন। এতে ভোটাররাও ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছেন। নির্বাচনে তিনি দশ দফা নির্বাচনী ইশতেহারও ঘোষনা দিয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে পার্বত্য চুক্তির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়নে জোরালো ভূমিকার উদ্যোগ, এলাকার জনমুখী ও পরিবশে বান্ধব সুষম উন্নয়নের মাধ্যমে সুবিধা বঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন নিশ্চিত, ব্যবসাবানিজ্যে সম্প্রসারনের লক্ষ্যে অনুকুল পরিবেশ গড়ে তোলা,ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপন এবং স্থানীয় ভিত্তিক বানিজ্যি প্রকল্প প্রনয়ন ও বাস্তবায়নের উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদী অপতৎপরতা, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস নির্মূলীকরনে দেশের গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল শক্তির সাথে একাতœ হয়ে বলিষ্ট ভূমিকা পালন, সামাজিক,সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে নারীর সম মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ উদ্যোগ, নারী উদ্যোক্তা শ্রেনী গড়ে তোলার লক্ষে বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং স্বপ্ল ও বিরা সুদে ঋণদান কর্মসূচি গ্রহন করার উদ্যোগ গ্রহন করাসহ ইত্যাদি।
এদিকে, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) কাউখালী, নানিয়ারচর,লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলায় আধিপত্য বিস্তার রয়েছে। এবার এসব উপজেলায় সিংহ প্রতীকের প্রতি সমর্থন দেয়ায় সিংহ প্রতীক জয়যুক্ত হওয়ার ধারনা।
স্বতন্দ্র প্রার্থী উষাতন তালুকদার জানান, তিনি নির্বাচিত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায়, পার্বত্য চুক্তির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন। এছাড়াও এলাকার শিল্প বানিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়ন ও বেকার সমস্যা সমাধানসহ ইত্যাদি কাজ করে যাবেন।
আরেক হেভিওয়টে প্রার্থী বিএনপির প্রার্থী মনিস্বপন দেওয়ান ভোটারদের কাছে টানতে দশ উপজেলা চষে বেরিয়েছিলেন। তিনি নির্বাচিত হলে পাহাড়ের উন্নয়নসহ চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধে জোরালো পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপশি পাহাড়ে এই সমস্যাকে মাথায় রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা কিভাবে করা যায় তার পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলে দিয়েছেন নানান প্রতিশ্রুতিও। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থী দীপংকর তালুকদারকে হারিয়ে দিয়ে বিএনপির প্রার্থী হয়ে মণিস্বপন দেওয়ান জয়যুক্ত হন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের উপ-মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তবে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষে দল ছেড়ে এলডিপিতে যোগদান করলেও পরবর্তীতে এলডিপি থেকেও পদত্যাগ করেন তিনি। সর্বশেষ তিনি পুনরায় বিএনপিতে যোগদান করার পর বিএনপি থেকে চুড়ান্ত মনোনয়ন পান তিনি। তবে এবারের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মনিস্বপন দেওয়ান ভিন্ন মাত্রায় মাঠে নেমেছেন। বিএনপির নেতাকর্মীদের ধারনা সুষ্ঠ,অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে মনিস্বপন দেওয়ান অবশ্যই বিজয়ী হবেন।
নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, এ আসনে আওয়ামীলীগ,বিএনপি ও পিসিজেএসএসএর সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ তিন জন হেভিওয়েট প্রার্থী থাকলেও এবার নির্বাচনে মূল লড়াই হবে দীপংকর তালুকদার(নৌকা) ও উষাতন তালুকদার(সিংহ)-এর মধ্যে। তবে এই ভোট যুদ্ধে কে শেষ পর্ষন্ত বিজয়ের হাসিটি হাসবেন তা ৩০ ডিসেম্বর পর্ষন্ত সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.