৩শ বছরেও উন্নয়নের ছোয়া লাগেনি বসন্ত পাংখোয়া পাড়ায়!

Published: 28 Aug 2018   Tuesday   

রাঙামাটি সদর উপজেলার বালুখালী ইউনিয়ে অবস্থিত বসন্ত পাংখোয়া পাড়া। প্রায় তিন’শ বছরের পুরানো ১৫শ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের চুড়ায় অবস্থিত এই পাড়ায় বসবাস করে থাকেন পাংখোয়া সম্প্রদায়ের লোকজন। কিন্তু এই পাংখোয়া পাড়াটি সৃষ্টির পর থেকে উন্নয়ন থেকে সব কিছুতেই অবহেলিত থেকেই গেছে। 


সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, রাঙামাটি শহর থেকে কাপ্তাই হ্রদের ওপরে অবস্থিত বালুখালী ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নে একটি মৌজা হচ্ছে বসন্ত পাংখোয়া পাড়া। যদিও রাঙামাটি সদরের বালুখালী ইউনিয়নের মধ্যে অবস্থিত হলেও দুর্গমতার কারণে এই পাংখোয়া পাড়ার সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে জুরাছড়ি উপজেলার বনযোগী ছড়া ইউনিয়ন দিয়ে। এমনকি এই পাংখোয়া সম্প্রদায়ের লোকজনদের বাজার থেকে চিকিৎসা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করতে হয় জুরাছড়ি উপজেলায়।

 

সরেজমিনের সময় স্থানীয়রা জানায়, অতি পুরাতন এই বসন্ত পাংখোয়া পাড়ার লোকজনদের একমাত্র জীবিকা হচ্ছে জুম ও ফলজ বাগান চাষ । উৎপাদিত এ পন্য বিক্রি করে তাদের জীবন চলে। প্রায় ১৫ শ ফুটের উপরে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত হওয়ার কারণে এই পাংখোয়া পাড়াটিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের কোন ছোয়া লাগেনি। বরাবরের মতো অবহেলিত থেকেছেন ২৮টি পাংখোয়া পরিবার। দুর্গমতার কারণে এই পাড়ায় সরকারী উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা এ পর্ষন্ত কোন দিনই পরির্দশনে যাননি। এই পাড়ায় উচ্চ শিক্ষার হার একেবারেই কম বললেই চলে। হাতে গোনা এক দুজন উচ্চ শিক্ষা পেলেও বাকীরা প্রাথমিক পর্ষন্ত লেখাপড়া করে ঝড়ে পড়ে যাচ্ছে। যদিও এ পাড়ায় একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি পাড়া কেন্দ্র রয়েছে। এই পাড়ায় নেই কোন চিকিৎসা সুবিধা, একমাত্র নির্ভর করতে হয় বৈদ্য(ওঝা) এর উপর। আর চিকিৎসা নিতে হলে প্রায় ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার দুরত্বে দুর্গম পাহাড় ডিঙ্গিয়ে পায়ে হেটে যেতে বনযোগীছড়া স্বাস্থ্য ইউনিয়নে। এছাড়া পানীয় জলের প্রকট সংকট রয়েছে। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি ধরে তা ব্যবহার করে থাকেন। তবে শুস্ক মৌসুম আসলে পানী জলের তীব্র সংকট দেখা দেয়।


সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চারদিকে বন ও গাছালির ঘেরা পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান এই বসন্ত পাংখোয়া পাড়াটি। এই পাড়া থেকে রাঙামাটির অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখা মিলে। বিশেষ করে সকালের দিকে পাড়াটিকে মনে হয় চারদিকে কুয়াশার চাদরে ঘিরে রেখেছে। সে যেন এক অপরুপ দৃশ্য দেখা মিলে। এ পাড়া থেকে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের দেখা মিলে। দুর্গম পাহাড়ের ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে এই জায়গাটি একটি আকর্ষনীয় হয়ে উঠতে পারে।


বসন্ত পাংখোয়া পাড়াটি প্রায় তিনশ বছরের পুরানো তা বুঝা গেল ১০৭ বৎসরের বৃদ্ধা লালহিং পাংখোয়ার সাথে কথা বলে। তবে তিনি নিজের মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথাবার্তা বলতে পারেন না। তাই দোভাষী হিসেবে তার নাতিনী জ্যোতি পাংখোয়ার মাধ্যমে তার সাথে কথা বলতে হয়েছিল।

 

লালহিং পাংখোয়া জানান, এখনো বাড়ীতে নিজের কাজ নিজেই করতে পারেন। তিনি জানান, রাঙামাটির বসন্ত পাংখোয়া পাড়ার বসতি প্রায় তিনশ বছরের উপরে। এই বসন্ত পাংখোয়া পাড়ার তার জন্ম হয়েছিল, এমনকি তার নানা ও বাবার জন্মও এ পাড়াতে। তাই এই পাড়ায় তার জীবনের সমস্ত কিছু স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে।


বসন্ত পাংখোয়া পাড়ায় নারীদের মধ্যে প্রথম এইচএসসি পাশ করা জ্যোতি পাংখোয়া জানান, তাদের পাড়ার মধ্যে তিনিই  নারী হিসেবে প্রথম এইচএসসি পাশ করেছেন। বর্তমানে তিনি রাঙামাটি সরকারী কলেজ থেকে ডিগ্রি প্রথম বর্ষে পরীক্ষা দিয়েছেন। তিনি জানান, এই পাড়াটি অতি পুরাতন হলেও শুরু থেকে অবহেলিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এ পাড়ার লোকজন চিকিৎসা,শিক্ষা থেকে একজন নাগরিকের যে সব সুযোগ সুবিধা থাকার দরকার কিন্তু সবকিছুই অপূরণ রয়েছে।


বালুখালী ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার নিকোলাই পাংখোয়া জানান, বসন্ত পাংখোয়া পাড়ার সাথে যোগাযোগের প্রধান সমস্যা হচ্ছে রাস্তা। একমাত্র যোগাযোগের কাঁচা রাস্তা হচ্ছে বনযোগী ছড়া বাজার থেকে পাংখোয়া পাড়া পর্ষন্ত। এই দুর্গম কাচা রাস্তা দিয়ে পাংখোয়া সম্প্রদায়ের লোকজনেরা তাদের উৎপাদিত পন্য বাজারে বিক্রি করতে যেতে হয়। কিন্তু কাঁচা রাস্তা হওয়ার কারণে বর্ষাকালে হাটাচলা করা কষ্টকর হয়ে থাকে। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে রাস্তাটি পাকা করা না গেলেও ইটসিলিং করার জন্য দাবী জানান।


স্থানীয় কারবারী সনলাই পাংখোয়া, পাতে পাংখোয়া, তমতে পাংখোয়া,জোয়ামা পাংখোয়া,জলনেম পাংখোয়া, জৌরিন পাংখোয়াসহ অনেকে জানান, যোগাযোগ ব্যবস্থা সুবিধা না থাকায় তাদের উৎপাদিত পন্য সহজেই বাজারে বিক্রি করতে পারছেন না। যোগাযোগের জন্য রাস্তাটি মেরামত করে দিলে উৎপাদিত পণ্য সহজেই বাজারে বিক্রি করতে পারবেন।


১২৮ নং বসন্ত মৌজার হেডম্যান(মৌজা প্রধান) চিয়াজল পাংখোয়া জানান, এই বসন্ত পাংখোয়া পাড়াটি নানান সমস্যায় জর্জরিত। এখানকার লোকজনের একমাত্র জীবিকা হচ্ছে জুম ও ফলজ বাগান। কিন্তু উৎপাদিত পন্য রাস্তা খারাপের কারণে সঠিকভাবে বাজারে নিয়ে যেতে পারছে না।

 

তিনি আরো জানান, এখানকার লোকজনের স্বাস্থ্য,শিক্ষাসহ নানান সুযোগ-সুবিধা থেকে যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত। পাড়ার লোকজন অসুস্থ হলে পায়ে হেটে ৪ ধেকে ৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পাশ্ববর্তী বনযোগী ছড়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যেতে হয়। এছাড়া এ পাড়ার ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহন করতে পারলেও অউন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আর্থিক সামর্থ্য না থাকার কারণে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়তে পারছে না। সে জন্য এ পড়ায় উচ্চ শিক্ষিত লোক নেই বললেই চলে।


বালুখালী ইউপি চেয়ারম্যান বিজিয় গিরি চাকমা জানান, বসন্ত পাংখোয়া পাড়াটি অতি দুর্গম ও যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় অন্যান্য এলাকা থেকে পিছিয়ে রয়েছে। তবে তার ইউপি থেকে যতটুক সম্ভব পাড়ার উন্নয়নের জন্য সহায়তা হচ্ছে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত