আমাদেরও মনে প্রাণে ইচ্ছে ছিল অন্যান্যদের সাথে বিজু, সাংক্রাইন, বৈসুক,বিষু এর উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করতে। কিন্তু গত বছর ২ জুন সংগঠিত অগ্নিকান্ডে আমাদের সমস্ত আনন্দ বিষাদে পরিণত করে দিয়েছে। ঝুপড়ি ঘরে মানবেতরসহ অভাব অনটনের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছি। তাই এ অবস্থায় বছরে একটি মাত্র প্রাণের উৎসব বর্জন করা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই।
সম্প্রতি সরেজমিনের সময় রাঙামাটির লংগদু উপজেলার তিনটিলা,পূর্ব ও পশ্চিম মানিকজোড় ছড়া ও বাত্যা পাড়ায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত চন্দ্রা খীসা,কেয়া চাকমা,দয়াল সাগর চাকমাসহ আরো অনেকে এই মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, গেল বছর ১ জুন দিঘীনালা-খাগড়াছড়ি সড়কের খাগড়াছড়ি সদর থানার চার মাইল এলাকায় স্থানীয় যুবলীগ নেতা মো. নুরুল ইসলাম নয়নের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন ২ জুন সকালে লংগদুর বাত্যাাপাড়া থেকে লংগদু সদর পর্যন্ত লাশ নিয়ে স্থানীয় বাঙালীরা মিছিল বের করে। এসময় উচ্ছৃংখল লোকজন তিনটিলা,মানিকজোড় ছড়া ও বাত্যাপাড়ায় পাহাড়ীদের ঘর বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করে দেয়। এতে ১৭৬টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ন পুড়ে যায় এবং ৩৮টি বাড়ী আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আগুনে পুড়ে মারা যান গুণামালা চাকমা নামে এক বৃদ্ধা। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের পর ২৯ জনকে গ্রেফতার করা হলেও সবাই জামিনে রয়েছেন। যুবলীগ নেতা হত্যাকান্ডের ঘটনায় ১০ জুন রনেল চাকমা ও জুনেল চাকমা দুজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
সরেজিমনে জানা যায়, অগ্নিকান্ডের ঘটনার দশ মাস পরেও পুড়ে যাওয়া বাড়ী ঘরে আগুনের ক্ষত চিহৃ এখনো চারিদিকে ছিড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পুড়ে যাওয়া স্থানের পাশে ক্ষতিগ্রস্তরা ঝুপড়ি ঘর তৈরী করে কোন রকমে দিন যাপন করছেন। তবে সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঘর বাড়ি তৈরী করে দেওয়া প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো পর্ষন্ত কোন ঘর তৈরীর কাজ শুরু করা যায়নি। কয়েক দিন পর বর্ষা মৌসুম শুরু হবে। তখন এই ঝুপড়ি ঘরে থেকে কিভাবে বসবাস করবেন তা ক্ষতিগ্রস্তরা বুঝে উঠতে পারছেন না। এতে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে দিন দিন ক্ষোভ ও হতাতাশা বাড়ছে। এছাড়া আগামী ১২ এপ্রিল থেকে তিন দিন ব্যাপী পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক উৎসব বিজু,সাংক্রাইং,বৈসুক বিষু শুরু হচ্ছে। কিন্তু ২১৩টি পরিবারের আগুনে বাড়িঘরের সঙ্গে পুড়ে গেছে সব আনন্দ। তাই এবার ক্ষতিগ্রস্ত ২১৩ পরিবার এই উৎসব বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে।
তিন টিলা, বাত্যাপাড়া ও মানিক জোড় পাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত ভূবনিকা চাকমা, নিয়তি চাকমা, সুমিতা চাকমা, সুজিত চাকমাসহ অনেকে জানান, সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঘর বাড়ি তৈরী করে দেবে দেবে বলে আজ দশ মাস অতিবাহিত করেছে এখনো কোন ঘর তৈরীর কাজ শুরু করেনি। বর্তমানে ঝুপড়ি ঘরে থেকে কোন রকমে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে মানবেতর দিনাতিপাত করছেন। যেখানে বাড়িঘর নেই, কিছুই নেই- কি দিয়ে কোথায় কিভাবে উৎসব করবেন ? তাই তাদের মনে কোনো উৎসবের আনন্দ নেই। তারা বর্ষার শুরুর আগেই বাড়িঘর তৈরী করে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
লংগদু ইউপি চেয়ারম্যান ও ক্ষতিগ্রস্ত কুলিন মিত্র চাকমা আদু বলেন, গত ২জুন ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি পাহাড়ী গ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য দশ মাসেও সরকার ঘর বাড়ী নিমার্ন করে দেয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ঘরবাড়ী না থাকায়, অর্থাভাবে অনাহারে মানবেতর দিন যাপন করায় ক্ষতিগ্রস্তরা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের প্রধান সামাজিক উৎসব বিজু, সাংক্রাইন, বৈসুক,বিষু বর্জন করতে বাধ্য হয়েছে। এ উৎসব তিন গ্রামের লোকজনদের আনন্দ না হয়ে বিষাদ হিসেবে ধরা দিয়েছে।
আঠারকছড়া ইউপি চেয়ারম্যান মঙ্গল কান্তি চাকমা বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলছে ঘর বাড়ি তৈরী করে দেবে বললেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। ফলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার তারা খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছে এবং এখনো পর্ষন্ত মাথা গুজাবার ঠাই হয়নি। তিনি দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের ঘর বাড়ি তৈরী করে দেয়ার দাবি জানান।
এদিকে, উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি পাহাড়ী গ্রামে প্রাথমিক অবস্থায় ২১৩টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ তালিকা করা হলেও পরবর্তীতে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ইউপি চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে ১৭৬টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রকৃত তালিকা করা হয়। বাকী ৩৮টি পরিবার ছিল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ও ভাড়াটিয়া ছিল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের পূর্নবাসনের লক্ষে প্রতিটি বাসগৃহের জন্য ৩ কক্ষ বিশিষ্ট সেমি পাকা ঘর, ১টি রান্নাঘর ও ১টি শৌচাগারের জন্য প্রাক্কালিত মূল্য, আইটি ভ্যাটসহ ৫লাখ ২৫ হাজার টাকার বরাদ্দ অনুমোদন দেয়া হয়। তবে প্রতিটি বাসগৃহ নির্মানের জন্য চাহিদা অনুযায়ী আইটি ভ্যাট শতকরা ১০ শতাংশ বাদ দিয়ে ৪ লাখ ৭২ হাজার টাকা ধরা হয়। ইতোমধ্যে ১৭৬টি ঘর নির্মানের জন্য দুই বার টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। তবে টেন্ডারে মালামালের মূল্য কম হওয়ায় কোন ঠিকাদার টেন্ডারে অংশ নেননি। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে টেন্ডারে টাকার সংখ্যা বৃদ্ধি করে তৃতীয় দফায় টেন্ডার আহ্বান করে। এতে প্রতিটি বাড়ীর জন্য ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৪৭৮ টাকা করে প্রায় ১০ কোটি টাকার মূল্য আগামী ১৬ এপ্রিল টেন্ডারের সিডিউল জমা দেয়ার দিন ধার্য্য করেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোসাদ্দেক মেহ্দী ইমাম জানান, ক্ষতিগ্রস্ত ১৭৬ পরিবারের বাড়িঘর তৈরি করে দিতে এ পর্যন্ত দুই দফা টেন্ডার আহবান করা হলেও এ টেন্ডারে কোনো ঠিকাদার দরপত্র ক্রয় করেননি। প্রাক্কলন অনুযায়ী কোনো লাভের সম্ভাবনা থাকায় টেন্ডারে অংশ নেননি কেউ। আগে প্রতিটি ঘর তৈরির জন্য ৪ লাখ ৭২ হাজার টাকার প্রাক্কলন ব্যয় ছিল। এবার তা বাড়িয়ে ৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকা করা হয়েছে। তৃতীয় দফায় আহবান করা টেন্ডার জমা দেয়ার শেষ দিন আগামী ১৬ এপ্রিল। এরমধ্যে দুটি সিডিউল বিক্রি হয়েছে বলে তিনি জানান।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.