পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে রোডম্যাপ ঘোষনা করে কার্যকর পদক্ষেপ নিন,অন্যথায় কঠিন সংগ্রাম--সন্তু লারমা

Published: 06 Mar 2015   Friday   

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা আবারও ৩০ এপ্রিলের মধ্যে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সময়সূচি ভিত্তি রোডম্যাপ ঘোষনা করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন না করলে ১মে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের কথা সরকারকে স্মরণ করে দিয়েছেন।

 

তিনি বলেন, এ সময়ে মধ্যে সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষে সময় সূচিভিত্তিক রোডম্যাপ ঘোষনা করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন না করলে জুম্ম জনগণ তাদের অধিকার ও অস্তিত্বকে ঠিকিয়ে রাখার জন্য যে কোন মহুর্তে কঠিনতম সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে প্রস্তুত রয়েছে।

 

তিনি অভিযোগ করে বলেন, সরকার একদিকে চুক্তি বাস্তবায়ন করছে না, অন্যদিকে নানান উন্নয়ন নামে পার্বত্যাঞ্চলে চুক্তি বিরোধী কার্যকলাপ, জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব বিলুপ্তি ও পার্বত্য বুকে ইমলামিক অধ্যূষিত অঞ্চলে পরিণত করার যড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।

 

শুক্রবার রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তিন দিন ব্যাপী কেন্দ্রীয় দশম তম সন্মেলনে উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সন্তু লারমা এসব কথা বলেন।

 

রাঙামাটি সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গনে আয়োজিত সন্মেলনে উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জনসংহতি সমিতির প্রবীণ সদস্য মাধবীলতা চাকমা। বক্তব্যে দেন রাঙামাটি সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অরুন কান্তি চাকমা, এমএন লারমা মোমোরিয়েল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা,জনসংহতি সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শিশির চাকমা। গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠীর শিল্পীরা উদ্ধোধনী নৃত্য ও সংগীত পরিবেশন করেন। এর পর জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে জনসংহতি সমিতির সন্মেলন উদ্ধোধন করেন সন্তু লারমা। অনুষ্ঠানে তিন পার্বত্য জেলা জেলা থেকে সংগঠনের নেতাকর্মী ও সহযোগী সংগঠনের প্রতিনিধিরা পর্যবেক্ষক হিসেবে অংশ নিয়েছেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।


সন্তু লারমা তার বক্তব্যে আরও বলেন, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন এলাকা স্থাপনে সেনাবহিনীর হাতে ক্ষমতা দিয়েছে। পার্বত্য চুক্তিতে পর্যটন খাতকে পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে দায়িত্ব দেয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু এ দায়িত্ব সেনাবাহিনী,পর্যটন কর্পোরেশন ও পর্যটন মন্ত্রনালয়ের হাতে দেয়া হয়েছে। পর্যটন খাতকে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের হাতে দিয়ে সরকার চায় পার্বত্যাঞ্চল বুকে জুম্ম জনগনকে বির্পষস্ত করে রাখতে ও জুম্ম জনগন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই সংগ্রামে যাতে এগিয়ে যেতে না পারে। একথায় পর্যটনে পার্বত্যাঞ্চলে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের এ অঞ্চলে নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়া মানেই হল কোন না কোনভাবেই এ অঞ্চলের সেনা নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বকে জিইয়ে রাখা। জুম্ম জনগনের পক্ষ থেকে বার বার দাবির জানিয়ে আসছিল অপারেশন উত্তোরণসহ অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প সরিয়ে নেয়ার জন্য। কিন্তু সরকার কিছু কিছু ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিলেও বর্তমানে থেমে রয়েছে। তাই প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার যতদিন অগণতান্ত্রিক,গণবিরোধী শাসন ব্যবস্থা থাকবে এবং যতদিন পর্ষন্ত জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব বিলুপ্তি চিরতরে  ধ্সংস হবে না ততদিন পর্ষন্ত কি পার্বত্যাঞ্চলের বুকে সেনা শাসন থাকবে? কিন্তু তা আমরা মানি না, বিশ্বাস করি না।


সরকার উন্নয়ন নামে পার্বত্যাঞ্চলে মেডিকেল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে যড়যন্ত্রের জাল প্রতিষ্ঠা করেছে অভিযোগ করে সন্তু লারমা আরও বলেন, মেডিকেল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের এ অঞ্চলের জুম্ম জনগণ যুক্তিসংঙ্গতভাবে স্থগিত করার দাবি জানিয়ে আসছিল। এখানে মৌলবাদী উগ্রজাতীয়তাবাদী সম্প্রদায়িক শক্তি মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পর্যটনের স্থাপনের পরিকল্পনার সাথে একাত্নতা হয়ে জুম্ম জনগনের অস্তিত্ব বিলীন করার জন্য যড়যন্ত্র করছে।


তিনি বলেন, পার্বত্য সমস্যা সমাধানের লক্ষে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু সমস্যা সমাধান হয়নি, চুক্তিও বাস্তবায়িত হয়নি। বরংশ পার্বত্য সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে গণতান্ত্রিক ও গণমুখী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হতে পারছে না।


তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বুকে এখনো পার্বত্য চুক্তি বিরোধী জুম্ম স্বার্থ বিরোধী ইউপিডিএফ ও সংস্কারপন্থীরা সন্ত্রাস চালাচ্ছে। এসব সন্ত্রাসী সংগঠন সরকারের বিশেষ মহলের সাথে ও আর্ন্তজাতিক যড়যন্ত্রে যুক্ত হয়ে পার্বত্যাঞ্চলের পরিস্থিতি অশান্তি ও অস্থিতিশীল করে রাখতে চায়। ১/১১-এর সময়ে যড়যন্ত্রের জালে আবদ্ধ হয়ে জনসংহতি সমিতির কতিপয় প্রবীণ সদস্য নিজেদের স্বার্থে ইউপিডিএফের সাথে আতাত করে একাত্নতা হয়ে তারাও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী যড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে আসে। এ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে সরকারের কাছে নিষিদ্ধের জন্য বার বার দাবী জানানোর সত্বেও সরকার এখনো পর্ষন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি। তবে সরকার এ ব্যপারে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না তা সবাইয়ের কাছে স্পষ্ট। তাই চুক্তি বিরোধী সন্ত্রাস নির্মূলীকরনের জন্য আমাদের দরকার ঐক্য  সংহতি।

 

তিনি বলেন, সরকার তথা এদেশের শাসক গোষ্ঠী মনে করে জনসংহতি সমিতি পাহাড়ী মানুষ, জঙ্গলে থাকে, জুম্ম জনগণ কি বুঝবে আইন-কানুন। রাষ্ট্র পরিচালনা তাদের অভিজ্ঞতা বা কি জ্ঞান রয়েছে। কিন্তু আমরা সরকারকে জানাতে চায় আমরা সংখ্যালঘু হলেও আমাদের নিজস্ব স্বাধীনতা ছিল। আমাদের রাজত্বে শাসনতান্ত্রিক ইতিাস আসে। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা স্বাধীনভাবে রাজত্ব পরিচালনা করেছিল। আজকে যদি এ দেশের শাসকগোষ্ঠী মনে করে থাকে যে পার্বত্যাঞ্চলে যারা পাহাড়ী মানুষ রয়েছে তার কি বুঝবে, তারা আধুনিক শিক্ষা সভ্যতা কি বুঝবে। কিন্তু আমরা জানাতে চাই পার্বত্যাঞ্চলের মানুষ অতীতেও জ্ঞান গড়িমায় সমৃদ্ধ ছিল। ভবিষ্যতে তাদের জ্ঞান গড়িমা সম্প্রসারিত হবে।  আমরা সংখ্যায় কম হতে পারি কিন্তু আমরা আমাদের অধিকারের জন্য মৃত্যুকে জয় করেছি। আমরা মৃত্যুকে ভয় করি না। আমাদের অধিকারের জন্য জীবিত থেকে মৃত অবস্থায় থাকতে চায় না। আমরা চাই মানুষের মত বেঁচে থাকতে এবং বীরের মত মৃত্যুবরণ করতে। তাই অধিকারের জন্য আমাদের অবশ্যই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা আত্ননিয়ন্ত্রাধিকারের আন্দোলনে এগিয়ে নিতে যখন যেটা প্রয়োজন হবে সেই বাস্তবতার সামিল হয়ে জনসংহতি পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগনকে সাথে নিয়ে আন্দোলনে এগিয়ে যাবে।

 
তিনি বলেন, ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ দেয়ায় প্রয়াত নেতা এমএন লারমা গণ-আন্দোলন করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যাতে কাপ্তাই বাঁধ প্রতিষ্ঠা হতে না পারে। তার পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে জন্ম লাভ করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। মানুষের অধিকার, জুম্ম জনগণের আত্ননিয়নাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ সংগঠন। জনসংহতি সমিতি জন্মলগ্ন থেকে সংগ্রাম ও দুর্যোগের মোকাবেলার ইতিহাস রয়েছে। জনসংহতি সমিতি সব সময় আন্দোলন করে জুম্ম জনগণের জাতীয় ঐক্য এবং সংহতির উপর নির্ভর করে।


পাহাড়ীদের মধ্যে যারা জাতীয় পর্যায়ে দায়দায়িত্ব এবং জেলা ও উপজেলায় দল করে থাকেন তাদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন, এসব পাহাড়ীরা সেই সব দলের সাথে যুক্ত হয়ে পাহাড়ী স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত রয়েছে। তাদের কাছে এর আগেও অবেদন অনুরোধ নিবেদন করা হয়েছে যে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের স্বার্থের জন্য একতাবদ্ধ হওয়ার জন্য। পার্বত্য চুক্তি পক্ষে এগিয়ে আসার জন্য। কিন্তু আমরা তা দেখতে পাচ্ছি না। তাই আজকে এ সন্মেলনের মাধ্যমে আবারও জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে আবারও অবেদন অনুরোধ জুম্ম জনগণের স্বার্থে, পার্বত্য চুক্তি পক্ষে আপনার অবস্থান নেয়ার জন্য। যদি তা না হলে আপনি আপনার দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। কারন সে দল জুম্ম জনগণের কোন স্বার্থ দেখে না। তারা চাই পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে সরকার বা সে দল যে পরিকল্পনা বা বাস্তবতা গ্রহন করে থাকে তা  প্রষ্ঠিতা করতে চায় তাই আপনি সে দলের লোক হয়ে গেছেন। তাই আবেদন রাখতে চাই আপনি সে দল থেকে বেরিয়ে আসুন।


তিনি পার্বত্যাঞ্চলের স্থায়ী অধিবাসী ও জুম্ম জনগণকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে তথা আত্ননিয়ন্ত্রাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অধিকতর সামিল হওয়ার আহ্বানের পাশাপাশি জুম্ম জাতীয় ঐক্য ও সংহতি আরও সুদৃঢ় করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর জনসাধারণকে তিনি অনুরোধ জানান।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

 

 

 

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত