পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের নিজস্ব মাতৃভাষার বর্ণমালার পাঠ্যপুস্তক দুষ্প্রাপ্যতা থাকলেও প্রচলিত শিক্ষার প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জসগোষ্ঠীরা বেশ আগ্রহী। ঐতিহাসিকভাবে নানা সংকটময় সময়েও তাঁদের অব্যাহত জ্ঞান পিপাসা থেমে থাকেনি। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতার ঘাটতি থাকায় পাহাড়ের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সম্পন্ন এসব জাতি-গোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণমালায় সাহিত্য খুব বেশী বিকশিত হতে পারেনি বলে অভিযোগ।
জানা গেছে, আশির দশকের শেষদিকে ‘জাক (জুম ঈসথেটিক কাউন্সিল) জেনারেশন’ ১৯৮৭ সাল থেকে ‘দিক্পাদা’ নামে চাকমা বর্ণমালায় একটি ত্রৈমাসিক সংকলন প্রকাশ শুরু করে; যেটি অনিয়মিতভাবে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত টিকে ছিলো। সে সময়ে চাকমা বর্ণমালার কম্পোজফন্ট আবিষ্কৃত না হওয়ায় সাইক্লোস্টাইলেই ‘দিকপাদা’ আলোর মুখ দেখে। চাকমা বর্ণমালার হস্তাক্ষরকে ট্রেচিং পেপারে তুলে নব্বই দশকের শেষদিকে প্রকাশ ঘটে ত্রৈমাসিক ‘আলাম’র। চলচ্চিত্রকর্মী শুভাশীষ চাকমার সম্পাদনায় প্রকাশিত আলাম’র সূত্র ধরে গড়ে তোলা হয় বর্ণমালা ও ভাষাভিত্তিক সংগঠন ‘শিপচরণ সাহিত্য কেন্দ্র’।
১৭’শ শতকের দিকে স্বভাব কবি শিপচরণ সৃষ্টি করেন, অসাধারণ কাব্যময় ‘গোজেনলামা’। অবশ্য তারও অনেক আগে থেকেই চাকমা বর্ণমালায় লেখা ‘তালিক (তান্ত্রিক চিকিৎসা বিবরণ)’ ধর্মীয় গুরু ও বৈদ্যদের কাছে সযতনে রক্ষিত ছিলো। এটি এখনো থাকলেও প্রায় দুষ্প্রাপ্য। তবে বর্তমানে চাকমা বর্ণমালায় চাকমা ভাষার একটিমাত্র উপন্যাস লিখেছেন দেবপ্রিয় চাকমা। এছাড়া আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের মধ্যে মারমা-ত্রিপুরাসহ অন্য জাতিগোষ্ঠিগুলোর মাতৃভাষার বর্ণমালার পাঠ্যপুস্তকের সংকটও অবস্থা।
জাক, হুয়াং-বোই-ওবা’, ‘রেগা লাইব্রেরী’ মোনঘর পাঠাগার, ‘বনযোগীছড়া কিশোর-কিশোরী কল্যাণ সমিতি’ পাঠাগারসহ পার্বত্য এলাকার সবকটি সৃজনশীল প্রতিষ্ঠানে মাতৃভাষায় লেখা বইপত্রের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। শুধু তাই নয়, তিন পার্বত্য জেলায় তিনটি সরকারীভাবে পরিচালিত ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউ’ও এই দৈন্যতার উর্ধ্বে উঠতে পারেনি। অভিধানের নামে প্রকাশ করা হয়েছে বাংলা বর্ণমালায় চাকমা ভাষার শব্দ কোষ।
পাহাড়ের আলোক বাতিঘর মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ঝিমিত ঝিমিত চাকমা, দীর্ঘদিন ধরেই সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছেন। তার মেেত, সংকট-অস্থিরতা-পীড়ন-বঞ্চনা আর দারিদ্র্য কখনো পাহাড়ীদের পিছু ছাড়েনি। বৃহৎ জনগোষ্ঠির সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে গিয়ে বিপন্ন তাঁদের লিখিত মাতৃভাষা। তিনি দাবী করেন, বিগত দশক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজ নিজ বর্ণমালা চর্চা এবং লেখালেখির একটি ধারা সৃষ্টি হয়েছে। এটি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশের ভাষাবৈচিত্র্য সমৃদ্ধি পাবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিশেষ করে ‘পার্বত্য চুক্তি’র পর পাহাড়ে প্রায় সব জাতিগোষ্ঠির উৎসব-পার্বণ থেকে স্মরণীয় দিবসে প্রকাশিত অনিয়মিত সংকলনে নিজস্ব বর্ণমালার প্রচুর লেখা স্থান পাচ্ছে। তবে এটিকে একটি ইতিবাচক ও ভাষা সংরক্ষণের সম্ভাবনাময় দিক হিসেবে দেখছেন, সুখেশ্বর চাকমা পল্টু। যিনি একযুগেরও বেশী সময় ধরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মাতৃভাষা ও বর্ণমালা লালনে প্রণোদনা যুগিয়ে আসছেন।
তিনি বলেন, সমতলের তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ভাষাগুলোর অবস্থা অনেক বেশী প্রান্তিক। এসব ভাষার বিকাশ ও সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সমতলের বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠনও পাহাড়ের লেখকদের পাশে দাঁড়াতে পারে। কারণ এককভাবে সরকার যেমন সবকিছু করতে পারেনা তেমনি মুল্যায়ন ছাড়া পাহাড়ের সাহিত্য সমতলে পৌঁছুতে পারবে না।
জানা গেছে, চলতি মাসের প্রথমদিকে জাতীয় কবিতা পরিষদের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিতে পাহাড়ের কবি মৃত্তিকা চাকমাকে সদস্য মনোনীত করা হয়েছে। এর আগে প্রয়াত কবি সমুদ্র গুপ্তের সময় খাগড়াছড়ির লেখক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরাকে রাখা হয়েছিল।
অপর ভাষা ও সাংস্কৃতিক সংগঠন দীঘিনালা চাঙমা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠির প্রতিষ্ঠাতা আনন্দময় চাকমা বলেন, এ ধরনের প্রচেষ্টাকে পাহাড়ের ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় দারুণ উৎসাহ যোগাচ্ছে। তার মতে,ঢাকায় একুশের বইমেলায় বাংলা-ইংরেজী ভাষার শত শত বই প্রকাশ করছেন দেশীয় প্রকাশকরা। সে সব প্রকাশকরা যদি চাকমা-মারমাসহ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠির লেখকদের পাশে দাঁড়াতেন তাহলে প্রতিবছর অনেক লেখকের আত্মপ্রকাশ ঘটতো।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.