পাহাড়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর সাথে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে ‘জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী (ইউএনডিপি)’ কাজ শুরু করে বিগত ২০০৮ সালে। শুরুতেই স্থানীয় সংসদ সদস্য, পরিষদ চেয়ারম্যান, ৪ সদস্য, পরিষদের প্রধান নির্বাহী ও নির্বাহী কর্মকর্তাসহ প্রাথমিক শিক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে একটি সভা করা হয়। একদিনের যে সভায় ব্যয় করা হয়, ১ লক্ষ ৪ হাজার টাকা। তারপর খাগড়াছড়ির প্রকল্পভুক্ত চার উপজেলায় ১০টি বিলবোর্ড স্থাপনের জন্য ব্যয় করা হয় ৪ লক্ষ টাকা।
এভাবেই রাজকীয় ব্যয়-বাহুল্যে চলছে তিন পার্বত্য জেলায় ‘ইউএনডিপি-সিএইচটিডিএফ’র অর্থায়নে তিন জেলার প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নের মহা কর্মযজ্ঞ! আর প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নের এই অর্থনৈতিক উৎসবময় কর্মকান্ড বাস্তবায়নের জন্য বেশ ভালো বেতনে শুধুমাত্র খাগড়াছড়ি জেলাতেই নিয়োজিত আছেন, ২৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। একই কাঠামো বিদ্যমান অপর দুই পার্বত্য জেলা পরিষদেও। বলা চলে, পাহাড়ে এ যেনো এক বিকল্প ক্ষমতা কাঠামোও বটে।
এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় মিটিং-সিটিং ও ট্যুরের সাথে যোগ হয়, ৯৮ পৃষ্ঠার ‘জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কৌশলপত্র’ নামের একটি কম্পোজকৃত স্পাইরাল বাইন্ডিং সংকলনও। বিগত ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে প্রণীত সেই কৌশলপত্রটি প্রনয়নের ৬ মাস পরও দেখেনি আলোর মুখ। তেমনি সেটি খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর এখন খোদ জেলা পরিষদেই। এটি একই বরাদ্দে প্রণীত হয়েছে অপর দুই পার্বত্য জেলাতেও।
খাগড়াছড়ি সরকারী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ড. সুধীন কুমার চাকমা এবং বেসরকারী শিক্ষা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ‘জাবারাং কল্যাণ সিমিত’র নির্বাহী পরিচালক মথুরা ত্রিপুরার পরামর্শে (কনসাল্টিং) প্রণীত এই কৌশলপত্রে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন ও সেবার ক্ষেত্রে পার্বত্যাঞ্চলের বাস্তবতায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ন সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
এরমধ্যে অপ্রতুল অভিগম্যতা, ভৌগলিক দুর্গমতা, সাংস্কৃতিক অসংগতি,দ্রারিদ্র্য, শিক্ষার নি¤œমান, মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহনের সুযোগহীনতা, শিক্ষক পদায়নে অসংগতি, কর্মরত শিক্ষকদের গুণগত মান, অনুন্নত অবকাঠামো এবং দুর্বল পরিবীক্ষণ ব্যস্থা অন্যতম।
কৌশলপত্রে ক্ষৃদ্র –নৃ-গোষ্ঠদের মাতৃভাষাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষাকে ত্বরান্বিত করতে শুধুমাত্র পার্বত্য জেলা পরিষদের করণীয় হিসেবে ৫টি সুপারিশ প্রস্তাব করা হয়। এরমধ্যে ৪ নং সুপারিশে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)’ সাথে সমন্বয় রেখে ভাষা গবেষণা ও উন্নয়ন এবং পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশনা কার্যক্রম নেতৃত্ব দেয়ার লক্ষে একটি ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহনের প্রস্তাব করা হয়েছে। আর ৫ নং সুপারিশে জেলা পর্যায়ে বিদ্যমান ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’-কে ভাষা গবেষণা ও উন্নয়ন কাজে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
কৌশলপত্র প্রণয়নের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত খাগড়াছড়ির বিশিষ্টজন অধ্যাপক ড. সুধীন কুমার চাকমা মনে করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক বাস্তবতা, ১৯৯৭ সালের ‘পার্বত্য চুক্তি’ এবং ১৯৯৮ সালে সংশোধিত ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন’ অনুযায়ী তিনটি জেলা পরিষদের পক্ষেই এমন উদ্যোগ গ্রহন করা সম্ভব।
এক্ষেত্রে অর্থায়ন এবং সরকারের সদিচ্ছার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউ’ স্থাপন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার ফসল। তাছাড়া পার্বত্য এলাকায় ‘ইউএনডিপি’সহ বিভিন্ন বিদেশী দাতা সংস্থার সমর্থনও মিলবে।
কৌশলপত্রটি প্রণয়নের সাথে সম্পৃক্ত অপর সদস্য মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি সরকারের সর্বজনীন ও বাধ্যতামুলক প্রাথমিক শিক্ষাকে সফল করার ক্ষেত্রে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার বাস্তবতা। জেলায় এমন অনেক স্কুল আছে যেখানকার অধিভুক্ত এলাকায় শুধুমাত্র চাকমা-মারমা ও ত্রিপুরা শিক্ষার্থীদের বসবাস। যেখানে জুম মৌসুম এবং বর্ষাকালে বিদ্যালয়ে শিশুদের অভিগম্যতা যেমন কঠিন হয়ে পড়ে তেমনি উপস্থিতিও কমে আসে। তিনি এসব বিদ্যালয়সহ অন্যসব বিদ্যালয়ের ভৌগলিক-সাংস্কৃতিক-জনবৈচিত্র্য বিবেচনায় জেলাভিত্তিক শিক্ষাপঞ্জি প্রণয়নের ওপর গুরত্ব আরোপ করেন।
কিন্তু কৌশলপত্রটির প্রয়োগতো দূরে থাক সেটির প্রয়োজনীয়তাও যেনো উপেক্ষিত পার্বত্য জেলা পরিষদ কিংবা শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছেই।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে কর্মরত ‘ইউএনডিপি-সিএইচটিডিএফ’র শিক্ষা কর্মকর্তা হৃদয় কুমার ত্রিপুরা বলেন, পরামর্শকরা আমাদেরকে তিনটি কপি সরবরাহ করেছেন। এখন একটিমাত্র অফিস কপিই রক্ষিত আছে।
প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যয়বাহুল্য প্রসংগে তিনি বলেন, আমরা মুলতঃ পরিষদের প্রকল্পভুক্ত কর্মকর্তা। নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা বা অর্থনৈতিক দিক-নির্দেশনা দেয়া এখতিয়ার অর্থ যোগানদাতা ইউএনডিপি ও প্রকল্প বাস্তবায়নের অধিকর্তা পার্বত্য জেলা পরিষদের হাতেই।
তিনি প্রাথমিক স্তরে আদিবাসী শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষা নিশ্চিতের লক্ষে চারটি উপজেলার ৪০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহায়তা অব্যাহত আছে দাবী করে বলেন, সরকারের এ সংক্রান্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। বাস্তবায়ন শুরু হলে হয়তো ইউএনডিপি এবং পার্বত্য জেলা পরিষদ আরো এগিয়ে যাবে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চাইথো অং মারমা বলেন, কৌশলপত্রসহ ইউএনডিপির অর্থায়নে পরিচালিত অন্যসব প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচী দুর্গম ও দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকায় শিক্ষা বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে। তাছাড়া ‘এনসিটিবি’র মাধ্যমে সরকারও মাতৃভাষাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নিবেদিত। সরকারের পদক্ষেপ নিশ্চিত হলে আমরাও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সাথে সমন্বয় করে ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগসহ কৌশলপত্রের সুপারিশগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন শুরু করা হবে।
‘ইউএনডিপি-সিএইচটিডিএফ’র খাগড়াছড়ির ডিস্ট্রিক্ট ম্যানেজার প্রিয়তর চাকমা বলেন, আমাদের কর্তৃপক্ষ পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোকে বাস্তবায়নকারী অংশীদার হিসেবে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।
তিনি সংবাদকর্মী হিসেবে এই প্রতিবেদককে কোন তথ্য দেয়ার জন্য সঠিক ব্যক্তি নন বলেও জানান। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কৌশল, আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রসংগে জানতে চাইলে তিনি ‘সিএইচটিডিএফ’র ওয়েবসাইট এবং প্রয়োজনে ঢাকাস্থ প্রকল্প পরিচালকের সাথে কথা বলার অনুরোধ জানান। বাংলাদেশের ‘তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী’ তথ্য কর্মকর্তা থাকার বাধ্যবাধকতার বিষয়ে বলেন, আমরা ইউএন আইনেই চলি।
উল্লেখ্য, খাগড়াছড়িসহ অপর দুই পার্বত্য জেলায় ইউএনডিপিসহ জাতিসংঘের অনেকগুলো উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা সরাসরি এবং অংশীদারের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও তাঁদের কার্যালয়ে কোন তথ্য কর্মকর্তার পদ যেমন নেই তেমনি তথ্যের সহজ প্রাপ্যতাও মেলেনা।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.