শুক্রবার প্রয়াত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৩৪ তম মৃত্যু বার্ষিকী

Published: 09 Nov 2017   Thursday   

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সংসদ শহীদ মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার(এমএন লারমা) শুক্রবার ৩৪ তম মৃত্যু বার্ষিকী।

 

দেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের পাহাড়ি জনপদ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১৩ ভাষাভাষি পাহাড়ি জাতি গোষ্ঠী সমূহের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সত্তরের দশকে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এম এন লারমা। দেশ স্বাধীনের আগে গণপরিষদ এবং দেশ স্বাধীনের পর প্রথম জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। দেশের প্রথম সংবিধান রচনায় সংসদীয় আলোচনায় তিনি দক্ষতা ও বাগ্মীতার পরিচয় দেখিয়েছিলেন। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় বিপথগামী সতীর্থদের হাতে তিনি প্রাণ হারান।

 

এদিকে এমএন লারমার মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিসহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। রাঙামাটিতে  কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকালে  জেলা শিল্পকলা একাডেমী চত্বর  থেকে বনরুপা এলাকা পর্ষন্ত  বের করা হবে প্রভাতফেরী। শিল্পকলা একাডেমী চত্বরে অস্থায়ীভাবে নির্মিত শহীদ বেদীতে পুস্পমাল্য অর্পণ ও স্মরণ সভা। এছাড়া বিকালে   কতিবা পাঠের আসর, হাজার বাতি প্রজ্জ্বালন ও ফানুস বাতি উড়ানো হবে।

 

এমএন লারমা ১৯৩৯ সারে ১৫ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মহাপ্রুম নামক স্থানে(বর্তমানে কাপ্তাই বাধের কারণে বিলুপ্ত) জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা চিত্ত কিশোর লারমা, মাতা শুভাষিনী দেওয়ান। এমএন লারমার তিন ভাই ও এক বোন। সবার বড় জ্যোতি প্রভা লারমা(মিনু) ছিলেন একজন সমাজকর্মী। বড় ভাই শুভেন্দু লারমা(বুলু) ছিলেন একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী, দক্ষ সংগঠক ও বিপ্লবী। সব চেয়ে ছোট ভাই বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা)।

 

শহীদ এমএন লারমা ১৯৫৮ সালে রাঙামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে আইএ পাস এবং একই কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে ১৮ জুন তিনি পার্বত্য ছাত্র সমিতি নামে একটি সংগঠন গঠন করেন এবং সর্ব প্রথম পাহাড়ি ছাত্র সন্মেলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন।

 

১৯৬০ সাল আদিবাসী জনগণের জন্য এলো এক বিভাষিকাময় বছর। সে সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে কাপ্তাই জল বিদ্যূৎ প্রকল্প বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। পাকিস্তান সরকার ১৯৬৩ সালে ১৫ ফের্রুয়ারী রাষ্ট্রদ্রোহিতা অভিযোগ এনে তাঁেক গ্রেফতার করে এবং প্রায় দু বছর জেলে রাখার পর ১৯৬৫ সালে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

 

১৯৭০ সালে এমএন লারমা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন এবং একই বছর পাকিস্তান প্রদেশিক পরিষদে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে ১৫  ফেব্রুয়ারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠিত হয় এবং তিনি সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। পরে তিনি সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে বিপুল ভোটে জয়ী হন। ১৯৭৪ সালে পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে তিনি লন্ডন সফর করেন। আদিবাসী জনগনের আত্ননিয়ন্ত্রাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন পরিচালনা করে আসছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তৎকালীন সময়ে সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে আত্নগোপণ করেন এমএন লারমা এবং তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী জনগণের আত্ননিয়ন্ত্রাধিকার আদায়ের লক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সামরিক উইনিং ‘শান্তিবাহিনী, নামে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন।

 

১৯৭৬ সালের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রমে ‘শান্তিবাহিনীর, সামরিক তৎপরতা শুরু হয়। সামরিক তৎপরতা দ্রুত সম্প্রসারিত হয় যা ১৯৮০ সালের দিকে বেশী জোরালো হয়ে উঠে। এর পর ১৯৮২ সালে ২৪ জুন জনসংহতি সমিতির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এ সন্মেলনের পর আদর্শগত ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে জনসংহতি সমিতি শেষ পর্ষন্ত দ্বিধাবিভক্ত হয় এবং ১৯৮৩ সালের ১৪ জুন সর্ব প্রথম লারমা গ্রুপ (লম্বা)ও প্রীতি গ্রুপ (বাদি) পরস্পর সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৯৮৩ সালে ১০ নভেম্বর বিভেদপন্থীরা হামলা চালালে এমএন লারমা তার আটজন সহযোগীসহ শহীদ হন।


এদিকে, ১৯৭২ সালের সংবিধানে তিনি সকল সম্প্রদায়ের মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জোর দাবি ব্যক্ত করেছিলেন। অনেক সময় তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায়িত করা হয়, কিন্তু তিনি বাঙালি বা অন্য কোন জাতিগোষ্ঠির বিরুদ্ধে কোন কথা বলেননি। তিনি পাহাড়িদের অধিকারের জন্য সরকারের কাছেই দাবি ব্যক্ত করেছিলেন।


দীর্ঘ দেড় দশক ধরে বেসরকারি উন্নয়নে নেতৃত্ব দেয়া অরুণ কান্তি চাকমা দাবি করেন, দেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু’র ডাকে সাড়া দিয়ে এম এন লারমা দেশ এবং পার্বত্যাঞ্চলের সুন্দর ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় ‘বাকশাল’-এ যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু পঁচাত্তরের ভয়াল হত্যাযজ্ঞের পর অন্য অনেক রাজনীতিবিদের মতো তিনি সামরিক শাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পালিয়ে বেড়ান। এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশের অনুপস্থিতি আর নিয়মতান্ত্রিক পন্থা খুঁজে না পেয়ে সশস্ত্র পথ গ্রহণ করতে বাধ্য হন।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও তরুণ রাজনীতিক মিঠুন চাকমা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্ত্বার মুক্তি সংগ্রামে এম এন লারমা’র ভূমিকা গুরুত্বপূর্ন-তিনি অগ্রপথিক আমাদের। তাঁর নেতৃত্বেই আন্দোলন হয়েছে। তিনি সর্বোচ্চভাবে চেষ্টা করেছেন আন্দোলনে সফল হবার জন্য। তবে তার মানবিক ভূমিকা অথ্যধিক হবার কারণে ‘ক্ষমা করো এবং ভুলে যাওয়া’ নীতির বৈশিষ্ঠ্য না বোঝার কারণেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। তরুণ প্রজম্ম এখনো এম এন লারমাকে শ্রদ্ধা করে। তবে তাঁকে নিয়ে আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে মন থেকে উপলদ্ধি করাই শ্রেয় বলে মত দেন, এই তরুণ।


উন্নয়ন উদ্যোক্তা রিপন চাকমা জানান, এম এন লারমা শুধু পাহাড়িদের নেতা নন, তিনি সারা বাংলাদেশের নেতা ছিলেন। তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। জাতীয় সংসদের অধিবেশনে তাঁর দেয়া বক্তৃতাগুলো পড়লেই বোঝা যায় তিনি কতো দূরদর্শী ছিলেন। তিনি শুধু পাহাড়িদের কথা বলেননি, তিনি মেহনতি মানুষের কথা বলেছেন। তিনি বেঁচে থাকলে বাংলাদেশকে অনেক কিছু দিয়ে যেতে পারতেন। তরুণ সমাজকে তিনি এখনো আন্দোলিত এবং অনুপ্রাণিত করেন।


তিনি উন্নয়নের প্রেক্ষিতেও দক্ষ সংগঠক। তিনি পরিবেশবান্ধব মানুষ ছিলেন। প্রাণি হত্যা, বৃক্ষ নিধনে নিরুৎসাহিত করতেন।


রিপন চাকমা মনে করেন, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হয়তো এম এন লারমা’র সাথে হয়তো চমৎকার বোঝাপড়ায় পাহাড়ের অগ্রগতি আরো বিকশিত হতো এবং পার্বত্যাঞ্চলের ইতিহাস অন্যরকমও হতে পারতো।


পানছড়ির অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক যামিনী রঞ্জন চাকমা জানান, সত্তরের আগে তাঁর সাথে এক-দুইবারই দেখা হবার সৌভাগ্য হয়েছিল। ন্যায়-অন্যায়কেই তিনি বিবেচনা করতেন। তিনি পাহাড়ি-বাঙালি-চাকমা এগুলো গুরুত্ব দিতেন না। তিনি ধার্মিক ছিলেন। প্রাণি হত্যার বিরোধী ছিলেন। তাঁর মতো নেতা আমি দেখিনি।


পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য এবং বর্ষীয়াণ রাজনীতিক রক্তোৎপল ত্রিপুরা মনে করেন, চার দশক আগে এম এন লারমা বৈরী  স্রোতের বিপরীতে মানুষের জন্য যে ত্যাগ দেখিয়েছেন, তা এখন বিরল। তাঁকে ধারণ করার মতো সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতাও এখন অনুপস্থিত। তবে তাঁর অসাম্প্রদায়িক ও দূরদর্শী দর্শন চর্চার মাধ্যমে বর্তমান সময়েও অনেক প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা সম্ভব। জ্ঞান ও যুক্তিনিষ্ঠ রাজনীতিক হিসেবে তাঁর প্রয়োজনীয়তা পাহাড়ে কখনো ফুরোবার নয়।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত