লংগদু উপজেলায় যুবলীগের নেতা হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে তিনটি পাহাড়ী গ্রামে অগ্নিসংযোগের ঘটনার সাড়ে তিন মাস অধিক সময়েও ক্ষতিগ্রস্তরা নিজেদের বসত ভিটায় ফিরতে পারেননি। তবে সরকারের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে তিনটি পাহাড়ী গ্রামে কিছু কিছু পাহাড়ী পরিবার ফিরেছে।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ন প্রকল্প থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পূর্নবাসন হিসেবে সেমিপাকা ঘর নির্মানের অর্থ খুব শিগরিই পৌঁছাবে। অর্থ হাতে পাওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর নির্মানের কাজ শুরু করা হবে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য গেল ১ জুন দিঘীনালা-খাগড়াছড়ি সড়কের খাগড়াছড়ি সদর থানার চার মাইল এলাকায় স্থানীয় যুবলীগ নেতা মো. নুরুল ইসলাম নয়নের লাশ পাওয়া যায়। তিনি মোটর সাইকেলে ভাড়ায় যাত্রী নিয়ে লংগদু থেকে খাগড়াছড়ি গিয়েছিল। পরদিন ২ জুন সকালে লংগদুর বাট্ট্যাপাড়া থেকে লংগদু সদর পর্যন্ত লাশ নিয়ে স্থানীয় বাঙালীরা মিছিল বের করে। এ সময় তিনটিলা,মানিকজোড় ছড়া ও বাট্টাপাড়ায় পাহাড়ীদের ঘর বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে ২১২টি পাহাড়ীদের ঘরবাড়ি ও ৮টি দোকানঘর সম্পুর্ণ পুড়ে যায়। আগুনে পুড়ে মারা যান গুণামালা চাকমা নামে এক বৃদ্ধা ।
এ ঘটনায় লংগদু থানার পুলিশ উপ পরিদর্শক দুলাল হোসেন বাদী হয়ে ১৫ জনের নাম উল্লেখ এবং ৩ থেকে ৪শ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামী করে লংগদু থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। পাহাড়ীদের পক্ষ থেকেও ক্ষতিগ্রস্থ কিশোর কুমার চাকমা ১০ জুন লংগদু থানায় ৮৯ জনের নাম উল্লেখ করে তিনশ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এসব মামলায় পুলিশ ৬৯ জনকে গ্রেফতার করলেও অধিকাংশই জামিনে রয়েছেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে লংগদু উপজেলার তিনটিলা ও বাত্যা পাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে লংগদুর তিন টিলা ও বাত্যাপাড়ায় কিছু কিছু পাহাড়ী পরিবার টঙ ঘর তৈরী করে বসবাস শুরু করেছেন। অনেককে টঙ ঘর তৈরী করতে দেখা গেছে। তবে এসব পরিবার নিজেদের বসত ভিটায় ফিরে আসলেও অতি কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। গেল ২ জুন সংঘটিত অগ্নিসংযোগের ঘটনার ঘর বাড়িগুলোতে এখনো আগুনে পুড়ে যাওয়া চিহিৃত রয়েছে।
তিনটিলা এলাকায় ভিটেমাটিতে ফিরে আসা চন্দ্র সুর চাকমা,মিনাক্ষী চাকমা ননী বালা চাকমা মিনু চাকমাসহ অনেকেই জানান, সরকারের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে কিছু কিছু পরিবার বসত ভিটায় ফিরে আসলেও এখনো সহায়তা মিলেনি। এ পর্ষন্ত সরকার থেকে দুই বান্ডিল ঢেউ টিন ও ৩০ কেজি চাল দেয়ার ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। বর্তমানে অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে।
বাত্যাপাড়ায় ফিরে আসা সন্ধ্যা রাণী চাকমা, দয়াল সোনা চাকমা ও দেব চাকমা জানান, সরকার থেকে ঘর বাড়ি তৈরীর জন্য যাবতীয় সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল। সরকার থেকে কিছু ত্রাণ সহায়তা ও অন্যান্য সংস্থা থেকে যে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়েছে তা বর্তমানে শেষ হয়ে গেছে। এখন ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে কি খেয়ে, কি নিয়ে দিন যাপন করবো তা বুঝতে পারছি না।
বাত্যা পাড়ার মৌজার কারবারী(গ্রাম প্রধান) শান্তিময় চাকমা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ঘটনার পর আমাদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। দুই মাস ধরে কোন প্রকার ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছি না। এখন জঙ্গলী আলু ও কলা খেয়ে দিন যাপন করতে হচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চারা খেতে না পেয়ে কান্নাকাদি করছে। তাই এখন গ্রামের লোকদের নিয়ে কি খাবো, কি করবো তার কোন দিশা খুজে পাচ্ছি না। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে আমাদেরকে আর কেউই সাত্ত্বনাও দিচ্ছে না।
ক্ষতিগ্রস্ত মনি শংকর চাকমা জানান, সরকারী ত্রাণ হিসেবে গত ১২ জুলাই জেলা প্রশাসক ত্রাণ সহায়তা দেয়ার সময় ক্ষতিগ্রস্ত ১৮টি পরিবার ত্রাণ পায়নি। তবে পরে ২টি পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়। বাকী ১৬টি পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা না দেয়ায় তাদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে ক্ষতিগ্রস্থ আরো ১৮টি পরিবার ত্রাণ সহায়তা গ্রহন করেনি। পরে জেলা প্রশাসককে অভিযোগ জানানোর পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ৩৪ পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দেয়ার জন্য নির্দেশ দিলেও এখনো তারা ত্রাণ সহায়তা পায়নি। তিনি আরো জানান, সরকার থেকে ঘর নির্মাণসহ যাবতীয় সহায়তার আশ্বাসের পর নিরাপদ স্থানে পালিয়ে থাকা কিছু কিছু পরিবার গত আগষ্ট মাসের দিকে নিজেদের বসত ভিটায় ফিরে গিয়ে টঙ ঘর তৈরী করেছেন। এর মধ্যে তিন টিলায় ৮ পরিবার, বাত্যাপাড়ায় ৮ পরিবার এবং মানিকজোড় ছড়ায় ১০ থেকে ১৫ পরিবার রয়েছে। বাকী ক্ষতিগ্রস্ত পরিবাররা আশ্রয় কেন্দ্রে, আত্বীয়-স্বজন ও ভাড়া বাসায় রয়েছেন। এসব পরিবার এখন অশ্চিত ভবিষ্যত জীবনযাপন করছে।
এদিকে, লংগদু উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা তিন টিলা,বাত্যাপাড়া ও মানিকজোড় পাড়ায় প্রাথমিক অবস্থায় ২১৩টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হলেও পরবর্তীতে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে প্রকৃত তালিকা করে ১৭৬টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার পাওয়া গেছে। বাকী ক্ষতিগ্রস্ত ৩৮টি পরিবার ভাড়াটিয়া ছিল। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের পূর্নবাসনের লক্ষে ঘরবাড়ী নির্মাণের প্রাক্কলন ব্যয় ও নক্সা তৈরী করে জরুরী ভিত্তিতে চাওয়ার পর তা ব্যয় ও নক্সা পাঠানো হয়েছে। এতে প্রতিটি বাসগৃহের জন্য ৩ কক্ষ বিশিষ্ট সেমি পাকা ঘর, ১টি রান্নাঘর ও ১টি শৌচাগারের জন্য প্রক্কালিত মূল্য আইটি ভ্যাটসহ ৫লাখ ২৫ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। তবে প্রতিটি বাসগৃহ নির্মানের জন্য চাহিদা অনুযায়ী আইটি ভ্যাট শতকরা ১০ শতাংশ বাদ দিয়ে ৪ লাখ ৭২ হাজার টাকা ধরা হয়েছে।
লংগদু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাদ্দেক মেহেদী ইমাম বলেন,অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ তিনটি গ্রামের ১৭৬টি পরিবারের জন্য ঘর নির্মানের জন্য নক্সা তৈরী করে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের আশ্রয় প্রকল্পের কাছে পাঠনো হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্প অনুমোদনের চিঠি ইস্যূ করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে খুব শিগরিই অর্থ বরাদ্দসহ অনুমোদনের চিঠি হাতে পাওয়া গেলে ঘর নির্মাণের কাজ করা সম্ভব হবে।
তিনি আরো বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ইতোমধ্যে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রনালয় থেকে সাড়ে ২৫ লাখ টাকা অর্থ বরাদ্দ এসে পৌছেছে। এ অর্থ কয়েক দিনের মধ্যে জেলা প্রশাসক বিতরণ করবেন। এছাড়া ইউএনডিপি থেকেও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ সহায়তা দেয়ার কথা রয়েছে।
তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ২১২টি পরিবারের মধ্যে ৩৮টি পরিবার ভাড়াটিয়া ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ছিল তাদের ক্ষয় ক্ষতির ব্যাপারে আরো যাছাই-বাছাই করা হচ্ছে। তাদের জন্য কিছু সহায়তা দেয়া যায় কিনা তার চিন্তাভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবার তাদের নিজেদের বসত ভিটায় ফিরে এসেছেন। তাদের জন্য যাবতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.