দীর্ঘ ১৪ বছর পর কাপ্তাই হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননকৃত ডিম সংগ্রহের সফলতা পেয়েছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট রাঙামাটির নদী উপকেন্দ্রের মৎস্য বিজ্ঞানীরা। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে এই সফলতা কাপ্তাই হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের বংশ বিস্তারসহ মাছের সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।
জানা যায়,৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর আয়তনের কাপ্তাই হ্রদটি দেশের আভ্যন্তরীন উম্মুক্ত জলাশয়ের মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কৃত্রিমভাবে তৈরি হ্রদসমূহের মধ্যে অন্যতম। হ্রদটি মূলত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তৈরি হলেও মৎস্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। কাপ্তাই হ্রদ দেশীয় মৎস্য প্রজাতির এক বৈচিত্রময় ও সমৃদ্ধ জলভান্ডার। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ অন্যান্য গবেষণার সর্বশেষ রেকর্ড অনুযায়ী এই হ্রদে মোট ৭৫ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ রয়েছে। তার মধ্যে ৬৭টি দেশীয় প্রজাতির মাছ, আর বাকী ৮টি বিদেশি প্রজাতির মাছ। বিগত ৪ দশকে হ্রদে মৎস্য আহরণ বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। তবে আশঙ্কাজনক দিক হচ্ছে, মূূল্যবান কার্প জাতীয় মাছের ক্রমাবনতি। ১৯৬৫-৬৬ সালে রুই, কাতল, মৃগেল ও কালিবাউস সহ সামগ্রীকভাবে মেজর কার্প জাতীয় মাছ ছিল মোট মৎস্য সম্পদের প্রায় ৮১.৩৫%। যা ক্রমশ হ্রাস পেয়ে ২০১৫-১৬ সালে ৪-৫% এর নিচে নেমে এসেছে।
অন্যদিকে ১৯৬৫-৬৬ সালে ছোট মাছ বিশেষ করে চাপিলা, কেচকি, মলা ইত্যাদির পরিমাণ ছিল ৩-৪%। বর্তমানে ২০১৫-২০১৬ সালে সেটির পরিমাণ বেড়ে প্রায় ৮৫% এর কাছাকাছি পৌঁছেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়,১৯৬০ সালে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এর ফলে কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টি হয়। দুই দশক আগে সুপেয় পানির মাছের ভান্ডার ছিল এই হ্রদ। কিন্তু হ্রদে অপরিকল্পিতভাবে জাগ দেওয়া, অবৈধ জাল ব্যবহার ও মা-মাছ সংরক্ষণের অভাবে মাছের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
কাপ্তাই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র সুত্র জানায়, বোয়াল, চিতল, তেলাপিয়া, টুইট্টা, বাঁডা, মলা-ঢেলা, চাপিলা, বকরি, ফলাই, বাচকুট্টা, ফাইশ্যা, পাবদা, পুঁটি, বাইম, পুঁইয়া, টেংরা, টাকি, গজাল, সিং, শৈল, কুইচ্ছা, মাগুর, ছোট চিংড়ি, সরপুঁটি, কেচকি, বাইলাসহ উল্লে¬খ যোগ্য ছোট প্রজাতির মাছ কাপ্তাই হ্রদে উৎপাদিত হচ্ছে বেশি। অবৈধ জাগ, মা-মাছ শিকার ও কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরার কারণে এক দশক ধরে কাপ্তাই হ্রদে কার্পজাতীয় মাছের আকাল দেখা দেয়। যে কারণে প্রতিবছরই হ্যাচারিতে উৎপাদিত ২০ থেকে ৩০ মেট্রিক টন পোনা কাপ্তাই হ্রদে ছাড়া হয়।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের রাঙামাটির বিজ্ঞানীদের মতে, কাপ্তাই হ্রদে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন বিষয়ে সর্বশেষ গবেষণা হয় ২০০৩-০৪ সালের দিকে। ২০০৩ সালে কাপ্তাই হ্রদে সীমিত আকারে কার্প জাতীয় মাছের ডিম পাওয়া গিয়েছিল। দীর্ঘ ১৪ বছর পর কাপ্তাই হ্রদ থেকে কার্পজাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ) মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। হ্রদে আবারও মা-মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছে।
তারা আরো জানান, পার্বত্য অঞ্চলে চার-পাঁচ বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে (মাছের প্রজনন মৌসুমও) বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আগের গড়ে ৩ থেকে ৭ শতাংশ বেড়েছে। প্রাকৃতিক এই পরিবর্তন মা-মাছের ডিম ছাড়ার ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। এক যুগ আগে কার্পজাতীয় মাছের বড় প্রজনন ক্ষেত্র ছিল মেঘনা ও পদ্মা নদী। কিন্তু দূষণ ও অতিরিক্ত পলি জমায় ওই দুই নদীতে এখন আর মা-মাছ আগের মতো ডিম পাড়ে না। এখন হালদা নদীই দেশের কার্পজাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র। এর সাথে যোগ হয়েছে কাপ্তাই হ্রদ।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আবুল বাশার কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন কমে ছোট মাছের আধিক্যতা বাড়ার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেছেন, এ বছর কাপ্তাই হ্রদের লংগদু উপজেলার ফরেস্ট গার্ড সংলগ্ন কাচালং চ্যানেলে ১৪ বছর পর কার্প জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননকৃত ডিম সংগ্রহে সফলতা পাওয়া গেছে। এই সফলতা কাপ্তাই হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের বংশ বিস্তারসহ মাছের সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হয়েছে।
তিনি আরো জানান, কাপ্তাই হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে জাঁকের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন, বিএফডিসি ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের মজুদ ও সংরক্ষণ করতে হলে প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রগুলো পুনঃখননের মাধ্যমে এলাকাগুলোকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করতে হবে।
এই কর্মকর্তা বলেন, কাপ্তাই হ্রদে কার্পজাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননস্থলের বর্তমান অবস্থা নিরূপণ- শিরোনামে তিন বছর মেয়াদি একটি গবেষণা চলছে। হ্রদের নানিয়ারচর এলাকার চেঙ্গী চ্যানেল, বরকলের কর্ণফুলী চ্যানেল, লংগদু এলাকার কাচালং চ্যানেল ও বিলাইছড়ি এলাকার রেইংখং চ্যানেলে প্রজনন ক্ষেত্রের অবস্থা নিয়ে এই গবেষণা চলছে।
তিনি বলেন, হ্রদের চারটি প্রজননক্ষেত্রে এসব মাছ ডিম ছাড়ে। চারটি প্রজনন ক্ষেত্রের মধ্যে চেঙ্গী ও রেইংখং চ্যানেলে পানির প্রবাহ কমে গেছে। বাকি দুটি প্রজনন ক্ষেত্র কর্ণফুলী ও কাচালং চ্যানেলে প্রজননের পরিবেশ আছে। এই দুটি চ্যানেলের মধ্যে কাচালং চ্যানেলে এবার প্রায় পাঁচ কেজি ডিম পেয়েছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট রাঙামাটির নদী উপকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বেলাল উদ্দীন জানান, হ্রদে কার্পজাতীয় মাছের আশঙ্কাজনক অধঃগতি অবশ্যই ভাবার বিষয়। বাংলাদেশে কার্প জাতীয় মাছ রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস এর প্রাকৃতিক প্রজননস্থল সমূহের মধ্যে অন্যতম ছিলো কাপ্তাই হ্রদ। কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির শুরুর দিকে হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন ছিলো মোট উৎপাদনের ৮০ শতাংশের উপরে, যা বর্তমানে ৪-৫ শতাংশ নেমে এসেছে। ফলে অনেকের ধারণা ছিলো কাপ্তাই হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন হয় না।
এর প্রেক্ষিতে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০১৫ সাল থেকে হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কারণ অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে। ফলশ্রুতিতে ২০১৬ সালে হ্রদের কাচালং চ্যানেল থেকে প্রায় একযুগ পর গবেষকরা সীমিত আকারে নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করেন। কিন্তু প্রথমবার ডিম ফোটানোর ভালো ব্যবস্থা না থাকায় গবেষকরা ডিমগুলো কোন মাছের তা শনাক্ত করতে পারেননি।
তিনি আরো জানান, পরবর্তীতে ২০১৭ সালে ডিম ফোটানোর সমস্যা গুলো চিহ্নিত করে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে মৎস্য গবেষকরা। এতে গবেষকরা ব্যাপক সফলতা পান। প্রায় এক মাস সাতদিন পর গবেষকরা রুই, কাতলা মৃগেল, কালিবাউস মাছের আঙগুলি পোনা নিশ্চিত করেন।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.