জেলি ত্রিপুরা, শান্ত ত্রিপুরা, রাজেশ ত্রিপুরা, অভি ত্রিপুরাসহ ৯জন ত্রিপুরা শিশু গ্রামের সামান্য ফাঁকা জায়গায় খেলা খেলছে। এদের সবার বয়স ৬ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। কথা বলছে চাকমা ভাষা বিকৃতি করে যেন নতুন এক ভাষায়। ৯ জন ত্রিপুরা শিশুর মধ্যে শুধু রাজেশ ত্রিপুরা একটু একটু ত্রিপুরা ভাষায় কথা বলতে পারে। অন্যরা চাকমা ভাষার সুর মিলিয়ে এক নতুন ভাষায় কথা বলছে।
এরা ত্রিপুরা ভাষায়(মাতৃভাষায়) আর কথা বলতে পারে না। সম্প্রতি খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার পানছড়ি ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের আদি ত্রিপুরা পাড়ায় সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে এ চিত্র চোখে পড়ে। শুধু এ শিশুরা নয় এ গ্রামের ৭৩টি ত্রিপুরা পরিবারের মধ্যে প্রায় সবাই মাতৃভাষায় কথা বরতে পারে না। কথা বলে চাকমা ভাষার সাথে মিল রেখে কিছুটা বিকৃত করে। যেন এক নতুন ভাষায়।
কর্ণ রায় ত্রিপুরার চা দোকানে কথা হয় পূর্ণরানী ত্রিপুরা, নিঝুংগো ত্রিপুরা, অনিতা ত্রিপুরা আর বুড়িসোনা ত্রিপুরার সাথে। বুড়িসোনা ত্রিপুরার বয়স ৬০ বছরের উর্ধে আর অন্যান্যদের বয়স ৩০-৪০ এর মধ্যে। চা দোকানদারসহ কেউ আর ত্রিপুরা ভাষায় কথা বলতে পারে না।
বুড়িসোনা ত্রিপুরা বলেন আমার দাদা-দাদিরাও ত্রিপুরা ভাষায় কথা বলতে পারেন না। সবাই চাকমা ভাষার সাথে সুর মিলিয়ে কথা বলে। কথার ফাকে এক ত্রিপুরা মেয়ে এস চা দোকানদারকে বলেন মরে দ্বিগো চা দিয়োন(চাকমা ভাষায় হচ্ছে মরে দ্বিবে চা দে আর বাংলায় হচ্ছে আমাকে দু’টি চা দেন) বুড়িসোনা ত্রিপুরা হেঁসে হেঁসে বলেন দেখেন সবাই এভাবে চাকমা ভাষার সাথে সুর মিলিয়ে এভাবে কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন কি মামা তারা তিয়োন দি ভাত হিয়োন? এভাবে আমরা কথা বলি। চাকমা ভাষায় এর অর্থ হি তোন দিনেয় ভাত হেয়োজ ? আর বাংলায় হচ্ছে কি তরকারি দি ভাত খেয়েছেন ? চা দোকানে বসা আদি ত্রিপুরা নিবাসী পানছড়ি সদর ৮ নং ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার সুকময় চাকমা বলেন-সব আদি ত্রিপুরারা চাকমার ভাষার সাথে সুর মিলিয়ে এভাবে কথা বলেন তারা।
শুধু এ আদি ত্রিপুরা পাড়ার নয়, উপজেলার টিএন্ডটি টিলার আদি ত্রিপুরা পরিবারগুলো, কালানাল ত্রিপরা পাড়া, লোগাং ইউনিয়নের আমতুলির আদি ত্রিপুরারা একই ভাষায় কথা বলে থাকেন।
কখন থেকে মাতৃভাষাটি হারিয়ে ফেলেছে তা কেউ বলতে পারেন না। আদি ত্রিপুরা পাড়ার ত্রিপুরা আদি নিবাস রাঙামাটি। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের কারণে তারা উদ্ভাস্তÍ হয়। বসটি গড়ে তোলে পানছড়ি বাজার থেকে অর্ধ কিলোমিটার দূরে। গ্রামের নাম দেয় আদি ত্রিপুরা পাড়া। সেই থেকে এখানে বাস করছেন তারা। এসব আদি ত্রিপুরারা ত্রিপুরা ভাষায় কথ বলতে পারেন না। তবে তারা নিজেকে ত্রিপুরা জাতি বলে পরিচয় দেয়। ধর্মটিও অন্যান্য ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মতো সনাতন( হিন্দু ধর্ম) ধর্ম।
এ প্রসঙ্গে পানছড়ি ইউনিয়নের ৭, ৮, ৯নং ওয়ার্ডের মহিলা সদস্যা ও আদি ত্রিপুরার স্থায়ী বাসিন্দা হিরামতি বড়–য়া বলেন,আদি ত্রিপুরা পাড়ার আদি ত্রিপুরারা কেউ আর কক বরক ভাষায়( ত্রিপুরা ভাষা) কথা বলতে পারেন না। তবে পরিচয় দিয় ত্রিপুরা জাতি হিসেবে। এ গ্রামের অধিকাংশ ত্রিপুরা পরিবার গরীব, তাদের কোনো জায়গা জমি নেই। প্রায় সবাই দিন মজুর করে খেয়ে না খেয়ে থাকে। বসতবাড়ী করেছে আত্মীয়-স্বজনের জায়গায়।
তাই তাদের সব সময় মাথা নিচু করে থাকতে হয়। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারনে অধিকাংশ শিশু বিদ্যালয়ে যায় না। স্কুলে গেলেও ৪,৫ শ্রেণির পর ঝরে পড়ে। সেজন্য তিনি আদি ত্রিপুরা পাড়ায় একটি ত্রিপুরা শিক্ষা গণকেন্দ্র স্থাপন করে দেওয়ার জন্য সচেতন মহলের কাছে দাবি করেন। এর ফলে আদি ত্রিপুরারা নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে পারবে আর সচেতন হয়ে আস্তে আস্তে শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবে।
এ ব্যাপারে পানছড়ির লতিবান ইউনিয়নের ৩বার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সদস্য খগেশ্বর ত্রিপুরা বলেন-ত্রিপুরা ভাষা শিখার আগ্রহ থাকতে হবে এবং নিজেদের উদ্যোগে এ ভাষা শিখতে হবে। কক বরক ভাষার ডিকশিনারি পড়তে হবে এবং যারা ককবরক ভাষা পারে তাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। এতেই কক বরক ভাষা পারবে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.