জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সংসদ সদস্য শহীদ মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার(এমএন লারমা)বৃহস্পতিবার ৩৩তম মৃত্যূ বাষির্কী। তাঁর এই মৃত্যূ বাষির্কী উপলক্ষে রাঙামাটিতে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি।
উল্লেখ্য,১৯৮৩ সালে ১০ নভেম্বর বিভেদপন্থীরা হামলায় চালালে এমএন লারমাকে তার আটজন সহযোগীসহ শহীদ হন।
শহীদ এমএন লারমার ৩৩তম মৃত্যূ বাষির্কী উপলক্ষে আয়োজিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বৃহস্পতিবার সকালে প্রভাত ফেরী এবং শিল্পকলা প্রাঙ্গনে অস্থায়ীভাবে নির্মিত শহীদ বেদীতে পুষ্পমাল্য অর্পণ।পরে শিল্পকলা একাডেমী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে স্মরণ সভা। এ সন্মরণ সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীস রায়। আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা) সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এছাড়া বিকাল ৪টায় রয়েছে এমএন লারমা মেমোরিয়েল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে কবিতা পাঠের আসর এবং সন্ধ্যায় হাজার বাতি প্রজ্জ্বালন ও ফানুস বাতি উড়ানো।
শহীদ এমএন লারমার সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত ও সংগ্রামী জীবন:
এমএন লারমা ১৯৩৯ সারে ১৫ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মহাপ্রুম নামক স্থানে(বর্তমানে কাপ্তাই বাধের কারণে বিলুপ্ত) জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা চিত্ত কিশোর লারমা, মাতা শুভাষিনী দেওয়ান। এমএন লারমার তিন ভাই ও এক বোন। সবার বড় জ্যোতি প্রভা লারমা(মিনু) ছিলেন একজন সমাজকর্মী। বড় ভাই শুভেন্দু লারমা(বুলু) ছিলেন একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী, দক্ষ সংগঠক ও বিপ্লবী। সব চেয়ে ছোট ভাই বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা)।
শহীদ এমএন লারমা ১৯৫৮ সালে রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে আইএ পাস এবং একই কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে ১৮ জুন তিনি পার্বত্য ছাত্র সমিতি নামে একটি সংগঠন গঠন করেন এবং সর্ব প্রথম পাহাড়ি ছাত্র সন্মেলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন।
১৯৬০ সাল আদিবাসী জনগণের জন্য এলো এক বিভাষিকাময় বছর। সে সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে কাপ্তাই জল বিদ্যূৎ প্রকল্প বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। পাকিস্তান সরকার ১৯৬৩ সালে ১৫ ফের্রুয়ারী রাষ্ট্রদ্রোহিতা অভিযোগ এনে তাঁকে গ্রেফতার করে এবং প্রায় দু বছর জেলে রাখার পর ১৯৬৫ সালে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৭০ সালে এমএন লারমা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন এবং একই বছর পাকিস্তান প্রদেশিক পরিষদে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে ১৫ ফের্রুয়ারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠিত হয় এবং তিনি সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। পরে তিনি সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে বিপুল ভোটে জয়ী হন। ১৯৭৪ সালে পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে তিনি লন্ডন সফর করেন।
আদিবাসী জনগনের আত্ননিয়ন্ত্রাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন পরিচালনা করে আসছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তৎকালীন সময়ে সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে আত্নগোপণ করেন এমএন লারমা এবং তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী জনগণের আত্ননিয়ন্ত্রাধিকার আদায়ের লক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সামরিক উইনিং ‘শান্তিবাহিনী, নামে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন।
১৯৭৬ সালের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রমে ‘শান্তিবাহিনীর, সামরিক তৎপরতা শুরু হয়। সামরিক তৎপরতা দ্রুত সম্প্রসারিত হয় যা ১৯৮০ সালের দিকে বেশী জোরালো হয়ে উঠে। এর পর ১৯৮২ সালে ২৪ জুন জনসংহতি সমিতির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এ সন্মেলনের পর আদর্শগত ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে জনসংহতি সমিতি শেষ পর্ষন্ত দ্বিধাবিভক্ত হয় এবং ১৯৮৩ সালের ১৪ জুন সর্ব প্রথম লারমা গ্রুপ (লম্বা)ও প্রীতি গ্রুপ (বাদি) পরস্পর সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৯৮৩ সালে ১০ নভেম্বর বিভেদপন্থীরা হামলা চালালে এমএন লারমাকে তার আটজন সহযোগীসহ শহীদ হন।
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের দশ ভাষাভাষি ১৩টি আদিবাসী জাতিসত্বাদের আত্ননিয়ন্ত্রাধিকার আদায়ের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম ও জীবন উৎসর্গ করে গেছেন।
–হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/এনএ.