জুমিয়াদের এখন ঘরে ঘরে উঠছে জুমের পাকা সোনালি ফসল। রাঙামাটি জেলায় জুমিয়ারা ব্যস্ততার সময় অতিবাহিত করছেন ঘরে পাকা ধানের ফসল তোলার জন্য। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর সঠিক সময়ে বৃষ্টিপাতের কারনে জুম চাষের ফলন ভাল হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর রাঙামাটি জেলায় ৬ হাজার ৩৮৫ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়েছে। প্রতি হেক্টর জমিতে ১ দশমিক ৩৩ মেঃটন করে ৮ হাজার ৪৯২ মেঃটন চাল উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এবার প্রতি হেক্টর জমিতে নিদিষ্ট লক্ষমাত্রা অর্জন করে হেক্টর প্রতি ১.৪ মেঃটন করে ৯ হাজার ২৫৮মেঃটন চাল উৎপাদন হতে পারে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর এ জেলায় সবচেয়ে ভালো ফলন হয়েছে বিলাইছড়ি ও জুরাছড়ি উপজেলায়। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, রাঙামাটিসহ তিন পার্বত জেলায় পাহাড়ে পাহাড়ে জুমের পাকা সোনালি ধান তোলার ধুম পড়েছে। হাসি ফুটেছে জুম চাষিদের মুখে। এখন জুমিয়ারা তাদের পরিবার-পরিজনদের নিয়ে ব্যস্ততা সময় কাটাচ্ছেন। জুমিয়াদের জুমের ফসল তোলার পাশাপাশি চলছে নবান্ন্ উৎসবও।চাষীরা জুমে ধানের সাথে অর্থকরী ফসল হিসেবে ভূট্টা, মারপা, মরিচ, বেগুন, শসা, শিম, তিল, ঢেঁড়স, মিষ্টি কুমড়া, ঝিঙে, করলা, ফোরল, শাবারাং (এক প্রকার সুগন্ধিযুক্ত সবব্জি) জুমিয়া কচ, তূলা, হলুদও চাষ করেছেন। জুম চাষীরা জানান এ বছর উপযুক্ত পরিবেশে অনুকুল আবহাওয়ার ফলে জুমে ভাল ফলন হয়েছে। তবে কয়েক বছর আগে পাহাড়ে ইঁদুরের উপদ্রবে ঠিকমতো জুমে চাষাবাদ করা সম্ভব হয়নি। সে সময়ে ইঁদুরের উপদ্রবে ক্ষেত ক্ষতিসাধিত হওয়ায় জুমের পাকাফসল ঘরে তুলতে পারেননি তারা। ফলে অভাব-অনটনে কেটেছিল কয়েকটি বছর। সাম্প্রতিক মৌসুমগুলোতে ইঁদুর নিধসহ উপযুক্ত জলবায়ু ও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতে জুমে উচ্চফলন আসছে বলে জানান চাষীরা। জুম চাষীরা আরও জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকাসহ নিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে এ বছর জুমে বেশ ভালো ফলন হলেও চিন্তিত। কারণ জুম থেকে উৎপাদিত ধান সারা বছরের খোরাক জোটে না। কৃষি বিভাগ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা এবং ব্যাংক থেকে অল্প হারে ্ঋণ সহায়তা মিললে জুমে আরও ভালো ফলন পাওয়া যেত। বড়াদম ইউনিয়নের গোলাছড়ি এলাকার জুম চাষী অর্পনা চাকমা জানান, গত বছরের চেয়ে এবার জুমের ফলন অনেক ভাল হয়েছে। মগবান ইউনিয়নের বৌদ্ধ চাকমা জানান, এ বছর প্রায় ৩০-৪০ মন ধান ঘরে তুলতে পারবেন বলে আশাবাদী। জুম চাষের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন আদিবাসীদের এই ঐতিহ্যবাহী জুম চাষ আজ বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে এগিয়ে এসে এই জুম চাষ পদ্ধতিকে আধুনিকায়ন ও জুম চাষীদের ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এতে করে একদিকে এই অঞ্চলের খাদ্যর ঘাটতি পূরণ হতো তেমনি প্রান্তিক জুম চাষীদের জীবন পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হতো। রাঙামাটি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ- পরিচালক তরুন ভট্টাচার্য্য বলেন, এবার আবহাওয়া ভাল থাকায় জুমের ফলন ভাল হয়েছে। এবার রাঙামাটি জেলায় ৬ হাজার ৩৮৫ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, পাহাড়ের ঢালে বিশেষ ধরনের চাষাবাদকে বলা হয় জুম চাষ। সাধারনত পৌষ-মাঘ মাসে পাহাড়ের ঢালে পরিস্কার করে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে আগুনে পুড়িয়ে মাটি উপযুক্ত করে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে সুঁচালো দা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে একসঙ্গে ধানসহ নানা সব্জির বীজ বপন করা হয়। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে জুমের ধান কাটা হয়। জুম চাষ শুধু বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায় চাষাবাদ করা হয়ে থাকে। তবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও জুম চাষ হয়। এর মধ্যে ফিলিপাইন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যেসমূহ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মধ্য আমেরিকা, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, নেপাল ও অফ্রিকায়। ওইসব দেশের বিশেষ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠী এ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
–হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.