আগামী সোমবার ও মঙ্গলবার (১৩ থেকে ১৪ জুন) টানা ৩৬ ঘন্টা রাঙামাটি জেলায় সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি ঘোষনা দিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি(জেএসএস)।
বরকলের ভূষনছড়া ইউনিয়নে ছোট হরিণা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোট কেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত ও পুনঃ নির্বাচনে দাবীতে এ কর্মসূচি ডাকা হয়।
বৃহস্পতিবার রাঙামাটিতে বরকলের ভূষনছড়া ইউনিয়নে ছোট হরিণা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেন্দ্র দখল করে ভোট ডাকাতির প্রতিবাদে এবং পুনঃ নির্বাচনে দাবীতে আয়োজিত গণ সমাবেশে জেএসএস’র নেতৃবৃন্দ এ কর্মসূচি ঘোষনা করেন।
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বেধিপ্রিয় লালমা(সন্তু লারমা) অভিযোগ করে বলেন, পার্বত্য চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়িত না হওয়া এবং চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অচলাবস্থার কারণে এ অঞ্চলের ভিন্ন ভাষাভাষি পাহাড়ী জুম্ম জনগনে অস্তিত্ব ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যড়ষন্ত্র চালানো হচ্ছে। তারাই আজকে আওয়ামীলীগের দীপংকর তালুদারের নেতৃত্বে অনুপবেশকারীদের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় এবং বরকল ২৫ বিজিবি’র কমান্ডারের নির্দেশনায় ভূষণছড়া ইউনিয়নের নির্বাচনে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে আওয়ামীলীগ প্রার্থী মামুনুর রশীদকে বিজয়ী করা হয়েছে।
তিনি বরকলের ছোট হরিনা কেন্দ্রে পুনঃরায় নির্বাচন ঘোষনা না দেওয়া পর্ষন্ত রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় আন্দোলনসহ আরো কঠোর কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
রাঙামাটি জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গনে আয়োজিত গণ সমাবেশে জেএসএস’র জেলা শাখার সভাপতি সুবর্ণ চাকমার সভাপতিত্বে অন্যান্যর মধ্যে বক্তব্যে রাখেন বরকল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মনি চাকমা, আদিবাসী ফোরামের পার্বত্যাঞ্চল শাখার সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, এমএন লারমা মোমোরিয়েল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা,জেএসএস নেতা চিংহ্লা মং চাক, উদয়ন ত্রিপুরা, , ভূষণছড়া ইউনিয়নের মাওদ্দং মৌজার হেডম্যান দীপন দেওয়ান টিটো, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বাচ্চু চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির জেলা কমিটির সভাপতি টোয়েন চাকমা প্রমুখ। সমাবেশে কয়েক হাজার নারী পুরুষ যোগদান করেন।
সমাবেশ থেকে আগামী ১৩ ও ১৪ জুন টানা ৩৬ ঘন্টা রাঙামাটিতে সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচির ঘোষনা দেন জেএসএস’র জেলা শাখার সভাপতি সুবর্ণ চাকমা। তিনি বলেন,‘আগামী ১৩ জুন ভোর ৬টা হতে ১৪ জুন সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত মোট ৩৬ ঘন্টা রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় সড়ক ও জলপথ অবরোধ কর্মসূচি পালিত হবে। তবে অবরোধের সময় রোগী বহনকারী এ্যাম্বুলেন্স ও যানবাহন, আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর যানবাহন, অগ্নিনির্বাপক যানবাহন, জরুরী বিদ্যুৎ সরবরাহ গাড়ি, সাংবাদিকদের বহনকারী গাড়ি ও জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত যানবাহন অবরোধের আওতার বাইরে থাকবে।
সমাবেশে শেষে জিমনেসিয়াম চত্বর থেকে একটি বিশাল প্রতিবাদ মিছিল শহরের বনরুপা চত্বর ঘুরে গিয়ে আবারও জিমনেসিয়াম চত্বরে গিয়ে শেষ হয়।
সমাবেশ শুরু হওয়ার পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাঙামাটি জেলা কমিটির পক্ষ থেকে জনস্বার্থে জরুরী ভিত্তিতে বরকল উপজেলাধীন ৪নং ভূষণছড়া ইউনিয়নের ছোট হরিণা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের নির্বাচন বাতিল করা এবং অচিরেই উক্ত কেন্দ্রে পুন:নির্বাচনের জন্য জোর দাবি জানিয়ে রাঙ্গামাটি জেলার জেলা নির্বাচনী কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নিকট এক স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।
সন্তু লারমা তার বক্তব্যে অারো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারী উদ্যোগে আনীত ও পুনর্বাসিত পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ভূমির উপর যাদেরকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদেরই একজন হচ্ছেন এই মামুন। ভূষণছড়া বরকল উপজেলার সবচেয়ে উর্বর জায়গা, সবচেয়ে জনবহুল জায়গা যেখানে দাঙ্গা করে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে জুম্ম জনগণকে উৎখাত করে সেখানে বসানো হয়েছে এই মামুনদেরকে।
তিনি বলেন, আজকে সেটেলারদেরকে বাংলাদেশের সমতল অঞ্চলে পুনর্বাসন না করে তাদেরকে এখানে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করার ষড়যন্ত্র শুধু নয়, এই সেটেলারদেরকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সবক্ষেত্রে তাদেরকে সরকার প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। আজকে তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলের জুম্ম জনগণকে তাদের ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের স্থলে এই বাঙালি সেটেলারদেরকে পুনর্বাসন দিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে জুম্ম জনগণকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা, তাদের জায়গাজমি বেদখল করা এবং তাদের শাসতান্ত্রিক অংশীদারিত্ব হরণ করা।
তিনি বলেন, ভূষণছড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৩নং ওয়ার্ডের ছোট হরিণা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে যে নির্বাচন এবং তার যে ফলাফল, নির্বাচনের যে প্রক্রিয়া ও পরিবেশ, সেটাই প্রমাণ করে যে পার্বত্য অঞ্চলের সামগ্রিক পরিস্থিতি কী বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে। তিনি বলেন, যতদিন না পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হবে ততদিন পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলের বুকে সন্ত্রাস তথা শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নিপীড়ন, অত্যাচার-অবিচার অব্যাহত থাকবে।
সন্তু লারমা বিজিবির ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন, ছোট হরিণা ২৫ বিজিবি জোন তাদের সীমান্ত সুরক্ষিত রাখা, প্রয়োজনে দেশের স্বাথীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, পাশাপাশি জনগণের সাথে সংযুক্ত থেকে জনগণের কল্যাণার্থে তাদের ভূমিকা রাখার যে দায়িত্ব তা থেকে সরে এসে তারা সেখানে স্থানীয় আওয়ামীলীগের সেবাদাস ও ক্রীতদাস হয়ে আওয়ামীলীগের স্বার্থ সংরক্ষণ করেছে, যা তাদের অর্পিত দায়িত্বের চরম বরখেলাপ।
সমাবেশের সভাপতির বক্তব্যে সুবর্ণ চাকমা বলেন, ভূষণছড়া ইউনিয়নে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে আমাদের চেয়ারম্যান প্রার্থী দীলিপ কুমার চাকমার বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, এটা মেনে নেয়া যায় না। আওয়ামীলীগ সরকার আজকে সারা দেশে ভোটের নামে যে অরাজকতা সৃষ্টি করছে সেটা অবশ্যই প্রতিবাদ করা দরকার।
বরকল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মণি চাকমা ও মাউদং ইউনিয়নের হেডম্যান দীপেন দেওয়ান টিটো অভিযোগ করে বলেন, বিজিবির সহায়তায় স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও সেটেলার বাঙালিদের ভোট ডাকাতির ঘটনার তারা প্রত্যক্ষদর্শী ও ভিকটিম। তারা বলেন, বিজিবি সদস্যরা পাহাড়ি ভোটারদের আইডি কার্ড চেক করা ও মোবাইল ফোন জব্দ করার নামে পাহাড়িদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা প্রদান করে। তাদের উপস্থিতিতে সেটেলাররা লাঠিসোটা নিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দেন। দীপেন দেওয়ান বলেন, বিজিবি সদস্যরা তাকে ভোটকেন্দ্রে যেতে দেয়নি। ফলে তিনি সেদিন ভোটদান থেকে বঞ্চিত হন বলে তারা দাবী করেন।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, ভূষণছড়া ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ছোট হরিণা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের এই ভোট ডাকাতি ও জালিয়াতির নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে ঐ কেন্দ্রে অবিলম্বে পূনঃনির্বাচন ঘোষণা করা না হলে রাঙামাটি জেলার এই সড়ক ও জলপথ কর্মসূচি আরও জোরদার করা হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য জেলায়ও এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়া হবে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.