বান্দরবানে পুষ্টি বিষয়ক গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

Published: 21 Jun 2015   Sunday   

“শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করি, সুন্দর আগামী গড়ি” এই স্লোগানকে সামনে রেখে রোববার বান্দরবানে পুষ্টি বিষয়ক  গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সমকাল-সিভিল সোসাইটি এলায়েন্স (সিএসএ) ফর সান এর যৌথ আয়োজনে এ গোলটেবিল বৈঠকে শুরুতে আগত অতিথি ও স্কুলের শিক্ষার্থীরা স্বাক্ষর অভিযানে অংশ নেন।  স্বাক্ষরের পরে ডার্টবোর্ডে পুষ্টি বিষয়ক খেলায় মেতে উঠে শিক্ষার্থীরা। উৎসব মুখর পরিবেশে পুষ্টি বিষয়ক খেলায় অংশ নিয়ে আম, কাঁঠাল, কলা, আনারসসহ বিভিন্ন ফল জিতে নেয় শিক্ষার্থীরা।

 বৈঠক শুরুর আগে শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের পুষ্টি তথ্য চিত্র উপস্থাপন করেন সিভিল সোসাইটি এলায়েন্স (সিএসএ) ফর সান-এর ন্যাশনাল কো-অরডিনেটর ডা: সাহিদা আক্তার। তথ্য চিত্রে তিনি জানান, বাংলাদেশে শতকরা ৪১ শতাংশ (৫ বছর বয়সের নিচে শিশুরা) বয়সের শিশুরা তুলনায় খাটো, ৩৬ শতাংশ (৫ বছর বয়সের নিচে শিশুরা) শিশুরা বয়সের তুলনায় ওজন কম, ১৬ শতাংশ (৫ বছর বয়সের নিচে শিশুরা) শিশুরা বয়সের তুলনায় স্বাস্থ্য কম, ৩৩ শতাংশ (৫ বছর বয়সের নিচে শিশুরা) শিশুরা রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে এমন তথ্য উঠে আসে প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশের শিশু, কিশোরী ও মায়েদের মধ্যে অপুষ্টির হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে  অনেক বেশি। অপুষ্টি একটি নিরব ব্যাধি যা মহামারি আকারে বাংলাদেশে অসংখ্য শিশুর মৃত্যু ঘটাচ্ছে । শিশুদের মানসিক বিকাশ, মেধা ও বুদ্ধি এবং শারীরিক বৃদ্ধি বাধা পাচ্ছে। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে বান্দরবান পুষ্টির দিক থেকে ৬৪তম রয়েছে বলে তুলে ধরা হয়।

গোলটেবিলে উপস্থিত ছিলেন সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল আজম,চিকিৎসক মা ও শিশু বিশেষজ্ঞ আমিনুল ইসলাম, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হ্লাশৈনু মার্মা, সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমা, সমাজকর্মী জিরকুং সাকু, মানবাধিকার নেত্রী ডনাই প্রু নেলী, সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মনিরুজ্জামান, সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ মো: আবু তাহের ভূঁইয়া, সমাজকর্মী জেবা ত্রিপুরা, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল আজম , সমকাল সুহৃদ সমাবেশ জেলা সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান প্রামাণিক সহ ৫ টি স্কুলের শিক্ষার্থীরা ।

 সমকাল সিএসএ ফর সানের পুষ্টি বিষয়ক প্রচারাভিযানে পাঁচটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেয়ালিকা পত্রিকা প্রতিযোগীতায় অংশ নেয়। এতে প্রথম স্থান অধিকার করে বান্দরবান ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ, দ্বিতীয় স্থান বান্দরবান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, তৃতীয় স্থান বান্দরবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। বিজয়ীদের মাঝে বই, ক্রেস্ট ও সনদপত্র বিতরণ করেন অতিথিরা। প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া অন্য দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো, বান্দরবান কালেক্টরেট স্কুল র বালাঘাটা বিলকিছ বেগম উচ্চ বিদ্যালয়। অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের মাঝে শুভেচ্ছা ক্রেস্টও প্রদান করা হয়।

তথ্য চিত্র উপস্থাপন শেষে গোল টেবিল বৈঠক শুরু হয়। আলোচনার শুরুতে বক্তব্য রাখেন, কবি ও সাহিত্যিক চৌধুরী বাবুল বড়–য়া। তিনি বলেন, শিশুরা আমাদের ভবিষ্যত। শিশুরা পুষ্টির অভাবে ভুগলে তারা মেধার বিকাশের দিক থেকে বাধাগ্রস্থ হবে। যার প্রভাব পড়বে পড়ালেখাসহ সমাজের বিভিন্ন কর্মকান্ডে।

চিকিৎসক মা ও শিশু বিশেষজ্ঞ আমিনুল ইসলাম বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকেরা বেশি অপুষ্টি ভুগছে। বান্দরবানে এমন দুগর্ম এলাকা আছে যেখানে ইপিআই সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে হয়। সেখানে ৮৬ শতাংশ সফলতা অর্জন করেছে সরকার। প্রশাসনের সকলের সহযোগিতায় এই সফলতা। যাদের বাচ্চারা অপুষ্টিতে ভুগছে তাদেরকে জেলা সদর হাসপাতালে এসকেনো নামে একটি ইউনিটে এনে নীবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করা হয়।

সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হ্লাশৈনু মার্মা বলেন, পুষ্টির দিক থেকে আমরা কেন ৬৪ নাম্বারে থাকবো। এই পিছিয়ে পড়া থেকে এর উত্তোরণ দরকার। পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীদের ক্ষেত্রে একটি বিষয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, শিক্ষার দিক থেকে সাধারণ বাঙ্গালী নারীদের চাইতে আদিবাসী নারীরা অনেক পিছিয়ে আছে। এর মূল কারণ অজ্ঞতা।

সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমা বলেন, পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবারে খাদ্যাবাস না থাকায় এই অঞ্চলের অন্যান্য আদিবাসীদের তুলনায় উচ্চতার দিক থেকে বম ও ম্রোরা কিছুটা খর্বকায়। 

সমাজকর্মী জিরকুং সাকু বলেন, দুর্গম পাহাড়ে বাঁশ নেই, তরিতরকারি নেই। আর পুষ্টি? যদি পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার পাইতাম তাহলে সাংবাদিকের মতো আরো লম্বা হতাম। পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবারের ক্ষেত্রে দুর্গম পাহাড়ের নারী ও শিশুদের কথা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।

মানবাধিকার নেত্রী ডনাই প্রু নেলী বলেন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কাজে আমাকে গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। আমি উপলব্ধি করেছি একজন গর্ভবতী মাকে গাছের লতা-পাতা ছাড়া আর তেমন কিছু খাবার খেতে দেওয়া হয় না। যেখানে ওই সময়ে মাকে মাছ, মাংসসহ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার দেওয়ার প্রয়োজন ছিল।  

সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মনিরুজ্জামান বলেন, আমি প্রথমে সমকালকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। সমকাল এই শিক্ষা মূলক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বিজ্ঞান বিতর্কসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণসচেতনতা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি, শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসে শিক্ষা গ্রহণের জন্য। শিক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্য অধিকারী হতে হবে। সুস্থ না থাকলে শিক্ষার্থীরা কখনো ভালো রেজাল্ট করতে পারবে না। এই জন্য তাদেরকে সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে। এইজন্য প্রয়োজন সচেতনতা।

সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ মো: আবু তাহের ভূঁইয়া বলেন, বাংলাদেশে দারিদ্রতা রয়েছে এটা সত্য। অপুষ্টি নারী ও শিশুদেরকে বেশি গ্রাস করছে। আগামী প্রজন্মকে শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা ও দারিদ্র বিমোচন করাই একমাত্র উত্তোরনের পথ।   

সমাজকর্মী জেবা ত্রিপুরা বলেন, পুষ্টি বিষয়ে যদি বলি এর সঙ্গে দারিদ্রতার একটা যোগসূত্র আছে। আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। আমি গ্রাম থেকে উঠে এসেছি। আমি দেখেছি আদিবাসী সমাজে একটি কথা প্রচলন আছে বাচ্চা জন্ম হওয়ার পর ভালো খাবার দেওয়া যাবে না। ডিম হাওয়ানো যাবে না। মাছ, মাংস খাওয়ানো নিষেধ। সামান্য তেল আর পেঁয়াজ দিয়ে শিশুদের খাবার দেওয়া হয়। এতে তাদের পুষ্টি বৃদ্ধি হবে কিভাবে? এর পেছনে দারিদ্র ও অজ্ঞতা বিরাট ভূমিকা রাখে। তারজন্য সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। 

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল আজম বলেন, প্রাথমিকে অনেক শিক্ষার্থী পুষ্টির অভাবে ভালো ফলাফল থেকে পিছিয়ে রয়েছে। পুষ্টির বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে এইসব শিশুরা আরো ভালো ফলাফল করবে।

সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস বলেন, পুষ্টিহীন শিশু জাতি গঠনে কখনো বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে না। পুষ্টিহীন শিশু দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্থ করে। এদেরকে এড়িয়ে গিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। 

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম জাপানের শিশুদের শিক্ষার মানের কথা তুলে ধরে বলেন, জাপানের শিশুর তুলনায় আমাদের দেশের শিশুরা শিক্ষায় তেমন অগ্রসর হতে পারছে না। দেশ থেকে দারিদ্র ও পুষ্টিহীনতা রোধে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।

সমকাল সুহৃদ সমাবেশ জেলা সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান প্রামাণিক বলেন, আমি সংবাদকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, বিশেষ করে সমকালের দিকে। সমকাল সমাজকে সচেতন করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে। তারই ধারাবাহিকতায় সমকালের প্রথম পাতায় প্রতিদিন অথবা সপ্তাহে তিন বা চারদিন পুষ্টি বিষয় নিয়ে এক কলামে সচেতনতামূলক লেখা ছাপানোর প্রস্তাব রাখেন। 

সমকালের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক ও বিশিষ্ট লেখক সুমন্ত আসলাম বলেন, সবার সম্মিলিত প্রয়াসে অপুষ্টির হার দূর করা সম্ভব।

সঞ্চালনার দায়িত্বে থাকা সমকাল সুহৃদ সমাবেশের বিভাগীয় সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম আবেদ বলেন, আমরা একই খাবার বারবার খাচ্ছি, পুষ্টি খাবার খাচ্ছি না। এর পরিবর্তন আনা দরকার। 

--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত